সমাজসংস্কারক বিশ্বনবী ﷺ
রাত্রির ঢেও নিজেদের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে এক শীতল শান্তময় সুবহে সাদেকের সময় গড়িয়ে আসে, সেই সময় আরবের মরুভূমিতে মা আমিনা ও পিতা আব্দুল্লাহর ঘরের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে এক মহামানবের আত্মপ্রকাশ হয়। মুক্তির আলোকবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে এলেন নিখিলের চিরসুন্দর সৃষ্টি মুহাম্মদ ﷺ । সমগ্র সৃষ্টি জগতে যেন বয়ে গেল আনন্দের ফল্গুধারা । প্রাক-ইসলামী যুগে যখন চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যাভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুন্ঠন, মদ্যপান, জুয়ায় ভরপুর ছিল। অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্ধ-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল ঠিক এমন সময় মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ সারা জাহানের হিদায়েতের জন্য আবির্ভূত হলেন। রাসুল ﷺ হলেন বিশ্ব মানতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমত স্বরুপ প্রেরিত। মহান বিশ্ব পরিচালক ঘোষণা করেনছেন, “আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি বিশ্ব জগতের জন্য বিশেষ রহমত স্বরুপ”। হযরত মুহাম্মদ ﷺ আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুহাম্মাদ ﷺ ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল ছিলেন, তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য, বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সাফল্য। মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত বা মহান আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। সত্য ও সুন্দরের শিক্ষা দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ অসত্য, অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা ও কুসংস্কারের গভীরতম সায়াচ্ছন্ন হয়ে ভুলে গেছে আপন পরিচয়, আপন স্রষ্টা আর সত্য সুন্দরের পবিত্র শিক্ষা। এমন ঘনঘোর অমানিশায়া দিশেহারা, পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে মুক্ত করতে ধরাধামে আর্বিভূত হন মহাপুরুষরা। তাঁরা আপন আলোয় উদ্ভাসিত করেন অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর মানুষকে বলে দেন মুক্তির দিশা। মহা নবী হযরত মুহা ম্মদ ﷺ এমনই একজন মানুষ যিনি মানবতার মুক্তির দিশারি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহা পুরুষ।
যখন মানব ও মানব-সমাজ পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, রাহাজানি ও খুন-খারাবিতে ছেঁয়ে যায়, তখন সে সমাজে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব হয়। চারদিকে তখন হাহাকার পড়ে যায় একজন সমাজ সংস্কারকের। যিনি ধ্বংসের হাত থেকে মানুষকে, সমাজকে উদ্ধার করবেন। সংস্কারের অভাবে বিশ্ববাসী এমন ধ্বংসের মুখোমুখিই হয়েছিল। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-‘তোমরা আগুনের কুয়ার পাড়ে উপনীত হয়েছিলে, উহা থেকে আল্লাহ তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)। ধ্বংস থেকে উদ্ধারকারী, নিমজ্জিতদের উত্তোলনকারী, আর্তচিৎকারকারীদের ত্রাণকারী, বিশ্বমানবের মুক্তির দূত ও রহমাতের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ । সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যিনি সংস্কার সাধন করে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন শান্তিময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তিনার মদীনা প্রজাতন্ত্রে ছিল না কোন পুলিশ, কোন দারোগা, কোন আদালত, কোন হামলা মামলা। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে যুদ্ধবাজ, দাঙ্গাবাজ, ফেতনাবাজ, দুর্ধর্ষ মরুবাসী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিকট তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর কি ছিল এমন যাদুকরী সংস্কার, যার বদৌলতে ও রকম একটি সমাজ আবার বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিময় সমাজে পরিণত হয়েছিল! আজ এই চরম অবক্ষয়ের যুগে নতুন করে সেই পয়গাম পৃথিবীবাসীর নিকট পৌঁছানো প্রয়োজন।
নবী ﷺ সর্বপ্রথম সকলকে সত্যের দিকে নিমন্ত্রন দেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে উৎসাহিত করলেন সত্যকে গ্রহণ করে নিতে। ধীরে ধীরে মানুষ শান্তির বাণী কালেমা পড়ে ইসলামের শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। এতে হয়ে গেল হৃদয় বা আত্মার সংস্কার। যেখানে ছিল কুফরী আর শিরকের ময়লা। সকল ধর্মেই শয়তানকে মানবের চিরশত্রু বলে হুশিয়ার করা হয়েছে। আর নবী করীম স. মানুষের মনের জগত হতে শয়তানের শয়তানিকে উৎখাত করে দিলেন। এখন আর কেউ কাউকে আঘাত করে না, হত্যা করে না। সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি মহান আল্লাহর নিকট হতে সফল কতিপয় নির্দেশনা পেলেন। সেগুলো একটি একটি বাস্তবায়ন করে সমাজকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র ও শান্তিময় করে গড়ে তুললেন।
দাসপ্রথার উচ্ছেদ: আরবে বহু যুগ ধরে গোলামীপ্রথা প্রচলিত ছিল। মনিবরা গোলামদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। তারা পশুর মতো জীবন যাপন করত। তাদেরকে বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মনিবদের নির্দেশ দিলেন ক্রীতদাসদের প্রতি সদাচরণ করো। তোমরা যা খাও, পরিধান করো, তা তাদের খেতে এবং পরিধান করতে দাও। তিনি তাদের মুক্তির পথ নির্দেশ করে ঘোষণা দিলেন, গোলামকে আজাদীদানের কাজ আল্লাহর কাছে একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তিনি অনেক দাস কে মুক্তি করে দেন এবং অনেক সাহাবী তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তার উদারতার জন্য দাস বেলাল (রা.) কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন এবং ক্রীতদাস জায়েদকে সেনাপতিত্বে বরণ করে দাসদের পূর্ণমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।
সংঘাতমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা: তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজত আর দীর্ঘকাল যাবত তা দাবানলের মতো জ্বলতে থাকত। রক্তপাত ও লুন্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের পেশা।
কুসীদপ্রথা উচ্ছেদ: কুসীদ প্রথা বলতে এক প্রকার সুদের কারবার প্রথা। আরব সমাজে জঘন্য কুসীদপ্রথা বিদ্যমান ছিল। তারা এত উচ্চহারে সুদের কারবার করত যে সুদ পরিশোধ করতে না পারলে সুদগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে নেওয়া হতো। আরবে প্রচলিত ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচণ্ড বাধাস্বরুপ ছিল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে “করজে হাসানা” দানে উৎসাহিত করেন।
কুসংস্কার হতে মুক্তি: আরবের জাহেলী সমাজে নানা কুসংস্কার ছিল। ভাগ্য নির্ধারক তীর, দেবদেবীর সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাতযাত্রার ধারণা প্রভৃতি চালু ছিলো। শুধু তা- ই না, আরো নানা প্রকার ভূত-প্রেত, দৈত্য, পরী প্রভৃতিকে বিশ্বাস করত।
তিনি কায়েম করলেন ন্যায় বিচার। একবার চুরির দায়ে মাখযুমিয়্যা গোত্রের এক মহিলার হাত কাটার হুকুম দিলে গোত্রের নেতৃবৃন্দ নবীজীর কাছে তা উড্ড করার সুপারিশ নিয়ে একজনকে প্রেরণ করে। তখন তিনি বললেন-‘যদি মুহাম্মাদের ﷺ কন্যা ফাতিমাও চুরি করতো, আমি তাঁর হাতও কেটে দিতাম। বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৩৪৭৫।’
বর্তমান নারীরা নির্যাতিত, নিগৃহীত সর্বত্র। এমতবস্থায় বিশ্বনবীর ﷺ দিক নির্দেশনাই নারীকে দিতে পারে মুক্তি। প্রাচ্য পন্ডিত গিব তাঁর “মোহাম্মডেনি জম” গ্রন্থে বলেছেন- “আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে , মোহাম্মদ নারী দেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।”
সমস্যাসঙ্কুল অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবজাতির সর্বাত্নক মুক্তির একমাত্র পথ বিশ্বনবীর ﷺ জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি সার্বিক মুক্তির অপূর্ব পথ তিনি বাতলে দিয়েছেন। এ সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত যে , তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুস্মরণে আজও মা নবজাতিকে রাষ্ট্রের দাসত্ব ও পুঁজি বা দীসমাজ ব্যবস্থার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত সুখী করা সম্ভব। রাজনৈতিক মুক্তির দিক নির্দেশনা উল্লেখ করে পাশ্চাত্যের খ্যাতিমান মনীষী র্জজ বার্নার্ডশ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “I belive if man like Mahammad ﷺ were to assume the dictatorship of modern world, he would succeed in solving the problems in way that would bring much needed peace and happiness”।
রেমান্ড লার্জ বিশ্বনবী ﷺ এর সমাজ সংস্কারে অবদান দেখে তিনাকে সামাজিক ও অন্তর্জাতিক আন্দলোনের প্রবক্তা বলে অখ্যায়িত করেন তিনি বলেন “The founder of Islam is in fact the promoter of social and international revolution of which history gives mention”
“যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”
কাজি নজরুল ইসলাম