কারুনের অহংকার, অবাধ্যতা এবং মুসা আঃ এর সত্যপ্রতিষ্ঠা: একটি ইতিহাসের পাঠ

ভূমিকা

মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী দেয় সাক্ষ্য যে আল্লাহ তায়ালা যাদের বেশি নিয়ামত প্রদান করেন তারাই সর্ব প্রথম আল্লাহকে অস্বীকার করে ফিরাউন, শাদ্দাদ থেকে আরম্ভ করে বর্তমানের বিশ্বের শীর্ষ দশ কোটিপতি সকলেই  আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে তাকেই ভুলে গেছে কারুন, মুসা আঃ এর যুগের সব থেকে ধনী সন্নামীয় ব্যাক্তির ইতিহাসও ঠিক এই রকমই।

কারুন তার সম্পদের বিবারন

কারুন ছিল মূসা হারুন আঃ পরে বনি ইসরাইলের সবচেয়ে জ্ঞানী, শিক্ষিত এবং তওরাতের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত। সম্প্রদায়ের সব থেকে সুন্দর, অনেক ধনী  হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন এক কোকিল কণ্ঠী ব্যাক্তি।  কিন্তু শীঘ্রই তার এই গুণাবলী তার অহংকার অত্যাচারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কারুনের সম্পদের ব্যাপারে কোরআনের সূরাহ-আল-কিসাসের ৭৬ নং আয়াতে বর্ণনা রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন যে “আমি তাকে এত ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম যার চাবি বহন করা কয়েকজন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল।“

তাফসীরে বাগাভিতে বলা হয়েছে যে কারুনের ধন ও সম্পদ এতই অধিক ছিল যে তার একটি দর্জার চাবি বহনের জন্য ৪০ জন শক্তিশালী মানুষের প্রয়োজন ছিল। 

কারুনের অবাধ্যতার কিছু ঘটনা

তার প্রথম অহংকার অবাধ্যতার ঘটনা তখন ঘটে যখন আল্লাহ তায়ালা মূসা আঃ-কে নির্দেশ দেন যে তিনি যেন আপন সম্প্রদায়কে আদেশ দেয় যে তাদের প্রতিপালক  তাদের পোশাকে চারটি সূতা ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে , প্রতিটি কোণে একটি করে আকাশী রঙের নীল সুতো ঝুলিয়ে রাখবে। তারা যখন এগুলো দেখবে তখন আপন রবকে স্মরণ করবে। সেই সময় মূসা আঃ আল্লাহ তায়ালাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন যে: "হে আল্লাহ , আপনি যদি তাদের সবুজ কাপড় পরিধান করারই নির্দেশ দেন তাহলে একটু বেশি উত্তম হবে, কারণ বনি ইসরাইল এই সুতা তুচ্ছ মনে করবে" তখন  আল্লাহ তার প্রতুত্তরে বলেন যে: "হে মূসা, আমার কোন আদেশই ছোটো নয়, যদি তোমার সম্প্রদায় এই আদেশটিকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে জেনে নিবে যে এরা আমার কোন আদেশই পালন করবে না" 

মূসা আঃ তখন সকলকে ডেকে বলেন যে আল্লাহ তোমাদের সকলকে নিজ নিজ পোশাকের চার কোনে সবুজ সুতা ঝুলানোর নির্দেশ দিয়েছে, যেন তোমরা ওগুলো দেখে আল্লাহকে স্মরণ করতে পারো। বনি ইসরাইলের সকলেই মূসা আঃ- আদেশ মেনেই নিত, কিন্তু তখনই কারুন বলে উঠল যে এই আদেশটি শুধু গৃহস্ত ধনী ব্যাক্তিদের জন্য প্রযোজ্য, যেন তারা সকলের মধ্যে কিছু প্রাধান্য পায়। এটাই ছিল তার অবাধ্যতা অত্যাচারের আরম্ভ। 

দ্বিতীয়বার তার অজ্ঞতা তখন প্রকাশ পায় যখন মূসা আঃ বনি ইসরাইলকে সমুদ্র পার করাচ্ছিলেন। কারুন তখন হঠাৎ মুসা আঃ-কে বলে উঠে যে হে মুসা তুমি আল্লাহর তরফ থেকে বার্তা গ্রহণ করো  এবং হারুনকে গির্জার সভাপতিত্ব প্রদান করেছো, কিন্তু আমি এত ধনী জ্ঞানী হওয়ার সত্ত্বেও আমার কাছে কোন অধ্যক্ষতা নাই। আমি তওরাতের পণ্ডিত এই অবস্থায় থাকতে পারব না। 

মূসা তাকে উত্তর দেন যে হে কারুন আমি হারুন আঃ-কে এই পদে নিয়োগ করিনি, আল্লাহ তাকে এই সন্মান দিয়ে ভূষিত করেছেন। 

কারুন তখন জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠে যে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি আমাকে এর প্রমাণ দেখাবে। 

তখন মূসা আঃ বনি ইসরাইলের সমস্ত নেতাদের জড়ো করেন এবং বলেন যে "তোমরা নিজের লাঠিগুলি নিয়ে এসো" ,তারপর সেগুলো একত্রে বেঁধে একটি তাঁবুতে নিয়ে যেখানে তিনি আল্লাহর উপাসনা করতেন সেখানে রেখে দেন। এবং সকলেই নিজের লাঠিগুলির সকাল পর্যন্ত পাহারা দেয়। সকালে সবাই দেখতে পায় যে হারুনের লাঠিতে সবুজ পাতা গজিয়েছে এবং এটি বাদামের গাছের লাঠিতে পূরণ হয়েছে

মূসা আঃ তখন কারুনের দইকে ইশারা করে বলেন যে  "হে কারুন, তুমি দেখলে তো আল্লাহকে তার আমল অনেক পছন্দ ?"  কারুন তখন বেবাক হয়ে বলে: "আল্লাহর কসম, এটি তোমার অন্য জাদু কাজের চেয়ে বেশি আশ্চর্যের কিছু নয়" 

এই বলে কারুন নিজ অনুসারীদের নিয়ে আলাদা হয়ে যায় এবং মূসা আঃ-কে কষ্ট দিতে শুরু করে কিন্তু মুসা আঃ তার প্রতি আদও রাগ করেন নি বরং বারংবার তাকে সঠিক রাস্তা প্রদান করার প্রচেষ্টা করতেন।  কিন্তু অবশেষে, কারুন একটি প্রাসাদ নির্মান করে এবং তার দরজা সোনার এবং  দেয়ালে সোনার পাত লাগায়। এর কারণে বনি ইসরাইলের সকল নেতারা তার কাছে আসতে শুরু করে, এবং কারুনের অনুসরণকারী নিরন্তর বৃদ্ধি পেতেই থাকে।

যাকাতের আদেশে তার প্রতিক্রিয়া 

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রসুলুল্লাহ মোহাম্মাদ সাঃ বলেছেন যে যখন বানী ইসরাইলের উপর যাকাতের আদেশ নাযিল হয় তখন মুসা আঃ কারুন-এর কাছে আসেন এবং তাকে বলেন যে তোমার উপর প্রতি এক হাজার দিনারের জন্য এক দিনার, প্রতি এক হাজার দিরহামের জন্য এক দিরহাম, প্রতি এক হাজার ভেড়ার জন্য মাত্র একটি ভেড়া এবং প্রতি এক হাজার জিনিসের জন্য এক জিনিস নিয়ে আপোষ করার নির্দেশ এসেছে, এর মাধ্যমে তোমার ভাইজনদের তুমি সাহায্য করতে পারবে।

এরপর বাড়ি ফিরে এসে কারুন যখন সকল জিনিসকে হিসাব করে দেখে সে জানতে পারে যে এটি তো অনেক বেশি, তাই সে বনী ইসরাইলদের একত্র করে নির্দেশ দেয় যে : "হে বনী ইসরাইল ! মুসা আঃ তোমাদের সবকিছু করতে বলেছে আর তোমরা তার সকল আদেশের পালন করেছো, কিন্তু এখন সে তোমাদের সম্পদ কেড়ে নিতে চায়" সে তাদেরকে বিষয়টি এমন ভাবে বলে যে সকল ইয়াহুদী মুসা আঃ-এর প্রতি রাগম্বিত হয়ে যায় এবং কারুনকে বলে যে : "তুমি আমাদের সর্দার, তুমি যা চাও তাই আদেশ দাও আমরা পালন করতে প্রস্তুত" 

মুসা আঃ-এর উপর অভিযোগের ষড়যন্ত্র ও তার প্রতিফল 

তখন কারুন ষড়যন্ত্র করে বলে যে : "মুসা আঃ নিজেই বলে যে ব্যভিচার করবে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে। এসো, আমরা একটি বেশ্যা নারীকে বলাই যে মুসা তার সাথে এই কাজ করেছে, যাতে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয় এবং আমরা তার থেকে পরিত্রাণ পাই" 

সকলেই কারুনের কথা মেনে মুসা আঃ এর প্রতি অভিযোগ লাগানোর জন্য এক বেশ্যা নারীকে ভারায় আনে। পরের দিন যখন মুসা আঃ নিজ সম্প্রদায়কে আল্লাহর বানী শুনাতে শুরু করে তখন কারুন জর গলায় তাঁকে বলে যে তুমি একটি মেয়ের সঙ্গে ব্যাভিচার করে কিভাবে আল্লাহর নাম নিতে পারো

মুসা আঃ তৌবা করে ওর দিকে ফিরে যান এবং তাকে বলেন যে মিথ্যা অভিযোগের চেয়ে শাস্তিজনক বিষয় কিছু নেই  

তখন কারুন বলে যে আমরা মিথ্যা কথা বলি না এবং সেই বেশ্যা মেয়েটিকে সামনে আনে। কিন্তু যখন মেয়েটিকে সবায়ের সামনে জিজ্ঞেস করা হয় তখন মেয়েটি সকল সত্য কথা বলে দেয় যে বানী ইসরাইল আমাকে আপনার উপর অভিযোগ করার জন্য টাকা দিয়েছে, কিন্তু আপনি হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত রসুল, নিষ্পাপ সরল ব্যাক্তি আপনার উপর এই অভিযোগ আমি কিভাবে লাগাতে পারি" 

এই বলে বেশ্যা মেয়েটি চলে যায়, এবং কারুনের মিথ্যা সকলের সামনে উজ্জ্বল হয়ে যায়। 

মুসা আঃ সেজদায় পড়ে কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন: "হে আল্লাহ, আমি যদি তোমার রসূল হই তবে আমার জন্য প্রতিশোধ নাও।

আল্লাহ তাকে তখনই ওহি পাঠান যে হে মুসা, আমি পৃথিবীকে আদেশ দিয়েছি যে সে তোমার আদেশ মানবে, তুমি যা চাও তাকে আদেশ দিতে পারো। 

মুসা আঃ তখনই নির্দেশ দেন: "হে বনী ইসরাইল! আল্লাহ আমাকে যেমন ফেরাউনের কাছে পাঠিয়েছেন, তেমনই কারুনের কাছেও পাঠিয়েছেন। তাই যে কারুনের সাথে আছে সে তার জায়গায় থাকুক, আর যে আমার সাথে আছে সে সরে যাক।" তারা সরে গেল এবং কারুনের সাথে শুধু দুজন লোক রয়ে গেল। তারপর মুসা বললেন: "হে পৃথিবী, তাদের ধরো," এবং পৃথিবী তাদের পায়ের সাথে ধরে নিল এবং আস্তে আস্তে তারা মাটির তোলে চলে গেল।

কারুনের মৃত্যুর পর বানী ইসরাইল বলতে মুসা আঃ এর উপর অভিযোগ জানাতে শুরু করে যে কারুনের সম্পদ নিজে নেওয়ার জন্য কারুনকে হত্যা করল। তারপর তিনি অনুরোধ করেন যেন কারুনের সকল সম্পদ মাটির তোলে চলে যায় এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই কারুনের সকল ধন সম্পদ বিনাশ হয়ে যায়। 

উৎস 

১) সুন্নি মুফাসসির হযরত হুসাইন বিন মাসুদ আল-বাগাওি দ্বারা লিখিত মাআ'লিমুল তানযিল (তাফসিরে বাগাওি), সুরাহ-আল- কিসাস।  

২) ইসলামিক এনসাইক্লোপেডিয়া, ক্কাফ হরফের পঞ্চম অক্ষরটি ক্কারুন।  

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter