মহৎ চরিত্র (৫): যুদ্ধক্ষেত্রে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)
মানবতার পূর্ণাঙ্গতা প্রদানের জন্য আবশ্যিক যুদ্ধ ক্ষেত্রেও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর আদর্শ-দৃষ্টান্ত প্রদশন করে দেখিয়েছেন। মনুষ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ লিপিতে অনাকাঙ্খিত লড়াই, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি যেহেতু আছেই, তা পরিহারের নিমিত্তে সর্বোত্তম নিয়ম-বিধি থাকা চায়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে রাসূলের (ﷺ) চারিত্রিক বৈশিষ্ট থেকে ঐসব নিরাময়-স্বরূপ গুণাবলীরই অন্নেষণ করা যাক। আবার মনে করা যাক, মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত নবীজির (ﷺ) শিক্ষায় নিহিত। অবশই রণভূমিও ব্যাতিক্রম নয়।
শ্রেষ্ঠ মানব আদর্শ নবী মুহাম্মদের (ﷺ) এই গুণটি সময়ের প্রয়োজন হিসাবে অন্বেষণ করা, জানা, শেখানো এবং ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া এবং গাজা যুদ্ধ সহ সারা বিশ্বে সংঘাতের ঘটনা বাড়ছে। নীতিনির্ধারক, কমান্ডার, যোদ্ধা এবং অন্যান্য নেতাদের এটি বিশেষভাবে জানা উচিত। যুদ্ধে অ-অংশগ্রহণকারীরাও নবী-প্রদত্ত শিক্ষা অনুধাবন করা চায় যাতে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা হয়। অন্যথায়, সকলেই যদি এই সার্বিক বাণীর প্রহরী হয় তবে তো পৃথিবীর বুকে আর কোনও লড়াই হবে না। জগতে সালাম ও শান্তিতে প্রতিফুল্ল হয়ে উঠবে।
আরও আগে আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। ইসলাম যুদ্ধ আকাঙ্খী বা লড়াই পিপাসু নয়। যেহেতু, ইসলামের আক্ষরিক ভিত্তিও শান্তির ওপর গঠিত যা সার্বিক শান্তি পন্থার প্রদর্শক। তাছাড়া নবীজির (ﷺ) আদর্শে যুদ্ধের অস্তিত্বই নাই, বরং সত্তা, পদ্ধতি, পরিভাষা এবং এবং জ্ঞানতত্ত্ব পরিবর্তনে সাধারণ আকারে জিহাদ এবং বিশেষ আকারে সরায়া ও গাজওয়া যেখানে পরেরটি স্বয়ং নবীর অংশগ্রহণের সাথে সুনির্দিষ্ট। আর তা না হলে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে সব যুদ্ধই রক্তক্ষয়ী এবং ব্যাপক নৃশংসতায় পরিপূর্ণ যেখানে মানবাধিকার কোন স্থান পায় না।
সাম্প্রতিককালে, একদিকে জিহাদ শব্দটিকে কেন্দ্র করে ইসলাম বিরোধী শক্তি নানা রকম চক্রন্ত চালাচ্ছে। তারা সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ এবং চরমপন্থার মিথ্যা মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ নির্দোষ মুসলমানদের লক্ষ্য করে ইসলামফোবিয়ার জন্ম দিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায়, এদিকেও মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে এটি নিয়ে নিয়ে দীর্ঘ উত্তপ্ত বিতর্ক রয়েছে। সে কারণেই একটি নতুন আখ্যানে পুনঃব্যাখ্যা করার অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে এটিকে আরো ঐতিহাসিক ও প্রতীকী এবং কম সারহীন, অর্থহীন এবং অকার্যকর করে তোলা হয়। যাইহোক, এর পরিভাষা একটি বিস্তৃত, সামগ্রিক এবং বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্গে যুক্ত। আক্ষরিক অর্থে জিহাদ হল ‘সংগ্রাম’ যা কোনো ব্যাতিক্রম ছাড়াই জীবনের সকল স্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত - শারীরিক, আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত, এবং সামাজিক। এর ব্যাপক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আখ্যান সৃষ্টি করলে বিশৃঙ্খলা তৈরী হবে। তবেই তো বলা হয়েছে: “আর শ্রেষ্ঠ জিহাদ সেই ব্যক্তির, যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নিজের মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।” (ত্বাবারানী) প্রাচ্যবিদদের বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনা দ্বারা প্রভাবিত অনেকেই এই বর্ণনার অপব্যাখ্যা করে থাকে। এই হাদিস শারীরিক জিহাদকে অবমূল্যায়ন করে না বরং অন্যায় ও অত্যাচার দূরীকরণের যেকোনো লড়ায়ে মানুষের অন্তরের অনিচ্ছার প্রতিবাদ করে।
যুদ্ধক্ষেত্রেও ইসলাম মানব অধিকারের প্রতি যথেষ্ট জোর দিয়েছে। তাই প্রথমত, ইসলাম সর্বদা একটি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের বিকল্প খোঁজে, যাতে তরবারির কোনো উপায় ও উপযোগিতা না থাকে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “এবং তারা যাদ সান্ধর দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তোমরাও ঝুঁকবে এবং আল্লাহ এর উপর ভরসা রাখো। নিঃসন্দেহে, তিনিই হন শ্রোতা, জ্ঞাতা।” (সূরা আনফাল, ৮:৬১)
তবুও যদি লড়ায়ের আবশ্যিকতা চলে আসে তাহলে অবশই অনুসরণীয় ঈশ্বর-ভিত্তিক নবী-প্রদত্ত এই নিয়মাবলী যা সব ধরনের সহিংসতা ও রক্তপাত দূর করার সব থেকে কার্যকরী উপকরণ শেখায়। অন্তরে খোদাভীরুতা বা আল্লাহর ভয় সর্বপ্রথম আবশ্যিকতা যাতে ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা, আবেগ ও আত্মস্বার্থের কোপে পরে কোনো সীমালঙ্ঘন না হয়ে যায়। এরই জন্য বিশ্ব শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (ﷺ) এসব বিষয় বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বুরায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে কোন বাহিনীর আমির বানিয়ে পাঠানোর সময় তাকে বিশেষ করে নিজের ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বনের এবং সঙ্গী মুসলিমদের কল্যাণ কামনার উপদেশ দিতেন।” (সহীহ মুসলিম)
একই হাদিসে রাসূলের (ﷺ) অনুরূপ কিছু নির্দেশাবলী বর্ণিত হয়েছে,”...বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, চুক্তি ভঙ্গ করবে না, শত্রু পক্ষের অঙ্গ বিকৃতি সাধন করবে না। শিশুদেরকে হত্যা করবে না।”
সহীহ বুখারীর একটি হাদিস, আবদুল্লাহ ইবনু ইয়াযীদ আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী (ﷺ) লুটতরাজ করতে এবং জীবকে বিকলাঙ্গ করতে নিষেধ করেছেন।” প্রতিপক্ষদের এবং ধর্মগুরুদেরও নিয়ে অনুরূপ নির্দেশ এসেছে। এমনকি যুদ্ধক্ষত্রে প্রাণী, বৃক্ষ, সম্পদ ইত্যাদিরও ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলা যাবে না। এমনকি যুদ্ধ পরিশেসে আশ্রয় অনুসন্ধান কারীদের সুরক্ষা ও বন্দিদের সঙ্গে সৎ আচরণ সুনিশ্চিত করে নবীয় আদর্শ।
অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত নবীর (ﷺ) জীবনের যুদ্ধের পরিসংখ্যান গণনা করেছেন। এটি আজকের যুদ্ধের ভয়াবহতার তুলনায় আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার। অনুরূপ একই পরিসংখ্যান হল নবীজির (ﷺ) ২৩ বছর জীবনকালে মোট ৮০টি সামরিক অভিযান সংঘটিত হয়েছে। এতে মোট ১০১৮ নিহত হয়েছে যার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ২৫৯ এবং প্রতিপক্ষের ৭৫৯ যা বর্তমানের তুলনায় একেবারে নগন্য যেখানে শুধুমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধতে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি।
অন্য আর এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, যুদ্ধে নবীর (ﷺ) অংশগ্রহণ উম্মাহ ও সত্যের জন্য তাঁর প্রস্তুতি এবং সাহসিকতার পরিচয় দেয়। একই সময়ে, একই সাথে একজন সেনাপতি ও তার লোকজন যুদ্ধক্ষেত্রে কেমন থাকবে তার বাস্তব চিত্রও পাওয়া যায়। নবী (ﷺ) যে সম্পূর্ণ মানবতার পরিপূর্ণ আদর্শ - তা যেন আংশিক না হয়ে যায়।