ধৈর্য্য ও ক্ষমাশীল আচরণ: রোজাদারদের অপূর্ব  বৈশিষ্ট্য

পবিত্র রমজান মাসের রোজা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে একটি যা আমাদেরকে  মহান করুণাময়ই আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যে নিয়ে আসে। কেননা রোজার সময় একজন ব্যক্তি পূর্ণ এক মাস ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকে এবং দাম্পত্য জীবনের কার্যাবলী থেকে নিজেকে সংযত রাখে। বিশেষভাবে সেই সমস্ত প্রত্যেকে কাজগুলিকে এড়িয়ে চলে যেগুলি পাপ হিসাবে গণ্য যেমন:  মিথ্যা বলা, গীবত করা, পরনিন্দা করা , অন্যকে কষ্ট দেওয়া, দাঙ্গা করা এবং  মারামারি করা ইত্যাদি। এই পবিত্র মাসে যেন মুসলিমরা আল্লাহ তায়ালার ঐশী গুণাবলীতে নিজেকে বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে তোলে। আর এই গুণগুলোই হলো যেগুলি একজন ব্যক্তিকে মহান করুণাময়ই আল্লাহ তায়ালার ঐশী দরবারের  কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং যার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দেন।

 

এখান থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় যে, বান্দার রোজা হতে হবে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের  জন্য, নিজের নাম ও চেহারা দেখানোর জন্য বা অন্যকে দেখানোর জন্য নয় যাতে লোকেরা তাকে রোজাদার  বলে। বরঞ্চ, রোজা রাখার সময় আমাদের এমন ভাবে রোজা রাখতে হবে  যেন আমাদের মনের ওপর মহান আল্লাহর স্মরণ পরিপূর্ণ ভাবে ছেয়ে যাই এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই। এটি করার সর্বোত্তম উপায় হল রোযার দিনগুলিতে মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র গ্রন্থ কুরআন এর বেশি বেশি  করে তিলাওয়াত করা ও ঘন ঘন ওয়ায-নসিহত এর  সমাবেশের ব্যবস্থা করা এবং এর  আলোয় নিজের আত্মা  ও হৃদয়কে আলোকিত করা।

 

কিন্তু যে ব্যাক্তি রমজান মাসে রোজা রাখে কিন্তু সে পার্থিব জগতের চিন্তাই মগ্ন ও পার্থিব কাজে ব্যস্ত থাকে এবং খোদার স্মরণ ও আখেরাতের চিন্তার ক্ষেত্রে সে ধীর ও অলস হয়ে থাকে। এমনাবস্থায় তাঁর রোযার ফরয তো পূর্ণ হবে, কিন্তু রোযার আধ্যাত্মিকতা- যা একটি আল্লাহর নৈকট্যে অর্জনের  গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, অর্জিত হবে না। যদিও বান্দার রোযার মূল উদ্দেশ্য প্রভুর সন্তুষ্টি লাভ এবং প্রভুর জন্য নিজের ইচ্ছাকে উৎসর্গ করা , কিন্তু এই ধরনের অবহেলাকারী রোজাদারদের উদাহরণ ঠিক তাদের মত যারা নিয়ত করে নামাজে দাঁড়ায় কিন্তু তাদের হৃদয় ও মন আল্লাহর স্মরণের এবং তার ধ্যানে মগ্নের মজা ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। মহান আল্লাহ তায়ালার  প্রতিদান সেই উপাসকদের জন্য খারাপ যারা মানসিক এবং আবেগগতভাবে তাঁর প্রার্থনার প্রতি উদাসীন, অথবা যারা শুধু লোক প্রদর্শনের জন্য প্রার্থনা করে, যেন মানুষরা তাকে দেখে রোজাদার বলে,  যার ফলে তারা উপবাসের আধ্যাত্মিকতা থেকেও বঞ্চিত থাকে ।

 

রাসুল সা. বলেন, “যে রোজা রেখে মিথ্যা ছাড়তে পারলো না তার উপস থাকা দিয়ে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই”। [বুখারি]

রাসুল সা. ইরশাদ করেন, “রোজা ঢাল স্বরূপ, মুমিনকে জাহান্নাম থেকে বাঁচায়; যতক্ষণ না সে ঢালটাকে বিদীর্ণ না করে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ঢাল বিদীর্ণ হবে কিসের দ্বারা? রাসুল সা. বললেন, মিথ্যা ও পরনিন্দার দ্বারা”। [তাবারানি]

হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. বলেন, “রোজা রেখে গালাগাল করো না, কেউ যদি তোমাকে গাল দেয় তাহলে তুমি বল, আমি রোজাদার, আমি রোজাদার”। [ইবন খুজাইমা]

অন্য বর্ণনায় রাসুল সা. ইরশাদ করেন, “রোজা ঢাল স্বরূপ, তোমাদের কেউ রোজা রাখলে সে যেন অশ্লিল কাজ না করে, হৈচৈ না করে, যদি কেউ তাকে গাল দেয় বা তার সঙ্গে কেউ যদি ঝগড়া করতে আসে তাহলে সে যেন বলে, আমি তো রোজাদার”।

এই বিষয়টির  দুটি রূপ রয়েছে। প্রথমত, কেউ যদি তার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছুক মনে হয় তবে সে যেন তাকে বলে যে আমি রোজাদার, আমার সাথে ঝগড়া করনা । দ্বিতীয়টি হল, যখন তার আত্মা তাকে ঝগড়াকারী ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করে এবং সে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তখন তার মনে মনে বলা উচিত, হে আত্মা, যুদ্ধ ও দাঙ্গা থেকে সাবধান হও।  লড়াই করার শক্তি থেকেও  লড়াই না করা হল একজন প্রকৃত রোজাদারের গৌরব। প্রতিশোধের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য্য ও ক্ষমাশীল আচরণ করাই হল আসলে রোজাদারদের গৌরব। এ ধরনের নিষিদ্ধ  কাজ পরিহার না করলে দুটি ক্ষতি হয়। প্রথমত, রোজাকে কমজর করে দেই । দ্বিতীয়টি হল রোজাদার ক্ষমার খোদায়ী নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন এবং ক্ষমাকারীদের ভালবাসেন।

 

 যদি রোজাদার ব্যক্তি লড়াই না করে এবং ক্ষমার সাথে কাজ করে, তবে এর ফলে তিনটি উপকারিতা হয়। প্রথমত,  যে রোজাদার ব্যক্তি ক্ষমার সাথে কাজ করে এবং আল্লাহর স্বভাব দ্বারা নিজেকে সভাবিত করে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমা করার ফলে , বিপরীত ব্যক্তির হৃদয়ে এক ধরণের সহানুভূতির জন্ম হয়। তৃতীয়টি হলো, মারামারি, দুর্নীতি  ও শত্রুতার আগুন থেকে সমাজও রক্ষা পায়। এই তিনটি জিনিস ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই অপরিহার্য যে, ক্ষমা করতে হবে, সহানুভূতি সৃষ্টি করতে হবে এবং সমাজকেও শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে, তবেই আমরা আমরা আমদের সমাজটিকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

অধিকন্তু, যদি কোন ব্যক্তি তার রোজাকে কেবলমাত্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণার পরিশ্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, তাদের আত্মাকে না বুঝে, তাদের আত্মার চাহিদা না মেটাই , তাদের আলো থেকে পুষ্টি না পায় এবং তাদের বাস্তবতাকে ভুলে যায়, কেবলমাত্র সে যদি সে তার প্রাত্যহিক জীবনের নীতই অবলম্বন করে, তাহলে তার রোজা একাংশে বৃথা হয়। যে এভাবে রোজা রাখবে তারা যেন নিশ্চিত ভাবে জেনে নেই যে, সে রোজাদারদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং সে শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো যারা ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে,  এতে  আল্লাহর কোন  সন্তুষ্টি অর্জন হয়না। এই  বিষয়ে হাদিসের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, “অনেক রোজাদার এমন আছে যার রোজা থেকে ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া কোনো ফায়দাই হয় না”। [ইবন মাজাহ]

 

 অপরপক্ষে যখন কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকে, তখন আল্লাহ তার অন্তরে অভাবী ও ক্ষুধার্তদের প্রতি ভালোবাসা ও মমতা এবং তাদের প্রতি দায়িত্ববোধের মানসিকতা জাগ্রত করেন।

 সঠিক রোযার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন একজন মানুষ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়, তখন সে বুঝতে পারে যে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার কারণে অসহাই মানুষদের কত কষ্ট হয়। দারিদ্র্যের কারণে অনেক মানুষ ক্ষুধার্ত ও  তৃষ্ণার্ত থাকতে বাধ্য হয় এবং তাদের খাওয়া বা পান করার মতন কিছু থাকে না । আন্তরিক রোজাদারদের হৃদয়ে এমন অভাবী মানুষের জন্য মমতা জন্ম নেয় ও  তাদের সমর্থনের মনোভাব ফুটে ওঠে। এভাবেই রোজাদারের অন্তর মানুষের সেবা করার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

 রোজা শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রচারের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে না, বরং সামাজিক স্তরে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা, সহানুভূতি এবং পরোপকারের একটি অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে এবং সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে।

সুতরাং, রোজা রাখার সময় পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে রোজার ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় দিকেরই বিশেষ খেয়াল রাখা আমাদের জন্য আবশ্যক। অর্থাৎ একদিকে মিথ্যা, গীবত ও মারামারি এড়িয়ে চলা, এবং রোজার আধ্যাত্মিকতায় নিজের হৃদয় ও আত্মাকে আলোকিত করা।  অন্যদিকে, আশেপাশের অভাবী ও অনাহারী লোকদেরও সম্বন্ধে জানা, যাতে এখলাসের সাথে অনাহারী ও অভাবগ্রস্তদের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে আমাদের দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়ই আনন্দ ও উজ্জল্ময় হয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter