ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর এক মুসলিম বাঙালি : চেপে রাখা ইতিহাসের আরেক পাতা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উঠতে বসতে বিজ্ঞানের সাথে জড়িত। নিত্য নতুন প্রযুক্তি দ্বারা বিজ্ঞান আমাদের জীবনের এক এক মুহূর্তের সাথে মিশে গেছে। বিজ্ঞান শাস্ত্রে  দুনিয়ার বিশিষ্ট ও অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকগন ছেড়ে গিয়েছেন নিজের ছাপ ও বিশাল অবদান। বিজ্ঞান প্রযুক্তি দ্বারা তৈরী বিভিন্ন বস্তুতে রয়েছে হাজার হাজার মুসলিম কিংবদন্তিদের।  যারা রেখে গিয়েছেন  তাঁদের  অবদানের মূল্য রতন। জীবন বিজ্ঞান থেকে ভৌত বিজ্ঞান, ভূগোল থেকে ইতিহাস ও  সাহিত্য থেকে প্রযুক্তি   বিজ্ঞানের সকল শাখা ছাড়া প্রযুক্তি সম্বন্ধনীয়  ময়দানে  রয়েছেন তাঁরা প্রবর্তন ও আবিস্কারক। 

তাঁরা ছিলেন সমস্ত আধুনিকতার আসল পথ প্রদর্শক । কিন্তু আজ হারিয়ে গেছে তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতা থেকে। চেপে রাখা ইতিহাসের বেড়া জালে লিপ্ত হচ্ছে মুসলিম আবিষ্কারকদের নাম। 

আজ আঙুলের ছাপ দিয়েই খুলে যাচ্ছে মোবাইলের লক, গেটের তালা,অফিসের উপস্থিতি, ফিঙারপ্রিন্ট নিয়েই যাচাই করা যাচ্ছে কে অপরাধী, এই ফিঙারপ্রিন্ট ডিটেকশান সিস্টেম প্রথম কে আবিষ্কার করেছিল জানেন?

প্রাথমিক জীবন

তিনি ছিলেন একজন বাঙালী,নাম খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক।জন্ম তাঁর ১৮৭২ সালে বাংলাদেশের  খুলনা জেলার কসবার পায়গ্রামে।ছোটোবেলায়ই তাঁর মাতা পিতা এক নৌকা দুর্ঘটনায় মারা যায়। আর বড়ো ভাইয়ের কাছে বোরো হয়।  হক ছিলেন সংখ্যাগত সমস্যা সমাধানের এক অদ্ভূত ক্ষমতা সম্পন্ন অকালপ্রাণ শিশু। তার অন্য আবেগ ছিল খাদ্য - সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি একজন আন্তরিক ভক্ষক ছিলেন। যেহেতু, পরিবার কঠিন ছিল হককে তার বড় ভাই তার খাদ্যাভাস সংশোধন করার জন্য প্রায়শই তিরস্কার করতেন। একদিন তার ভাই কাজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন যে হক তার নিজের ভাগের খাবার খাওয়ার পাশাপাশি তার ভাইয়ের খাবারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও খেয়েছেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি হককে মারধর করেন। অপমানিত ও হৃদয় ভেঙে হক সাহেব বাড়ি ছেড়ে ট্রেনে চড়ে ১৮৮৪ সালে কলকাতায় আসেন।

কলকাতা এসে এক ভদ্র লোকের কাছে আশ্রয় পায় আর স্কুলে পড়ার সুযোগ ও পায়। সেই তাঁর জীবনে আসে এক নতুন মোড়। তিনি কলকাতার বিখ্যাত ও পুরোনো প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন যেখানে তিনি গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন।

আবিষ্কারের ইতিহাস

তিনি কাজ করতেন তৎকালীন ব্রিটিশ রাজত্বের বেঙ্গল পুলিশে।ফিঙারপ্রিন্ট নিয়ে অনেকেই আগে কাজ করেছেন কিন্তু এর প্র‍্যাকটিক্যাল ইউজ কি,কিভাবে যাচাই করা যায়,কিভাবে ফিঙারপ্রিন্ট দিয়ে আলাদা করা যায় মানুষকে সেটা প্রথম আবিষ্কার করেন আমাদের এক মুসলিম বাঙালি কাজী আজিজুল হক। ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল পুলিশের আইজি ছিলেন এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে গবেষণার জন্য নিয়োগ করেন দুই বাঙালী প্রতিভাকে, একজন গণিতবিদ কাজী আজিজুল হক, আরেকজন হেম চন্দ্র বোস

কাজী আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোস ৭০০০ ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর এক বিশাল সংগ্রহ গড়ে তোলেন। অনেক পরিশ্রম করে একটা গাণিতিক সূত্র দাড়া করলেন যেটা দিয়ে ফিঙারপ্রিন্ট যাচাই এর মাধ্যমে মানুষ সনাক্ত করা যায়।আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিশাল বড় আবিষ্কার। এই পদ্ধতির নাম হওয়া উচিত ছিল "বোস-হক আইডেন্টিফিকেশান সিস্টেম"। কিন্তু ওখান থেকেই ইংরেজদের বেঈমানী শুরু।

পুলিশের আইজি হেনরী সাহেব এবার সবার কাছে প্রচার করা শুরু করলেন যে এই ফিঙারপ্রিন্ট ডিটেকশন সিস্টেম আবিষ্কার করেছেন উনি নিজেই। এমন কি কাজী আজিজুল হক-কে কোন রকম স্বীকৃতি দিতেই অস্বীকার করলেন। তিনি চুপি চুপি একটা পেপার পাবলিশ করেও ফেললেন নিজের নামে।ব্যাস, বাংলাদেশের কাজী আজিজুল হক আবিষ্কৃত সিস্টেম এর নাম হয়ে গেল "হেনরী ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম"

"হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম " এখন জগৎ বিখ্যাত, মোবাইলের টাচে, অফিসে, অপরাধী সনাক্তকরণে বলতে গেলে যত্ত জায়গায় ফিঙারপ্রিন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে, তত জায়গায় এই হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম-ই ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজ করে গেল আমার দেশের সূর্য্য সন্তান, কিন্তু নাম হচ্ছে এক বেঈমান ব্রিটিশ এর।

যদিও কিছুদিন আগে ব্রিটেনের "দ্যা ফিঙারপ্রিন্ট সোসাইটি" চালু করেছে "The Fingerprint society Azizul Haque & Hem Chandra Bose prize"।ওদিকে যে সিস্টেমের নাম হতে পারত "হোক-বোস সিস্টেম " তা আজ-ও "হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম"-ই রয়ে গেছে।আর অজানায় থেকে গেছেন আমাদের আজিজুল হক। 

আঙ্গুলের ছাপের বিষয়ে ঐতিহাসিক, গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয়ই, বছরের পর বছর ধরে সর্বসম্মতিক্রমে হকের ভূমিকাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে স্বীকার করেছেন যিনি আঙ্গুলের ছাপের হেনরি শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি তৈরি এবং নিখুঁত করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রেখেছিলেন। তার ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য হক 1913 সালে খান সাহেব এবং 1924 সালে মতিহারিতে একটি জায়গির (সামন্তীয় জমি অনুদান) সহ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে খান বাহাদুর উপাধি লাভ করেন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter