সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ এডভোকেট মাজিদ নূরানী: একজন প্রজ্ঞাবান আইনজীবীর দীর্ঘায়িত অবদান 

বিখ্যাত মুসলিম পন্ডিত, প্রসিদ্ধ আইনজীবী, সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, এবং প্রখ্যাত লেখক, এডভোকেট আব্দুল গফুর মাজিদ নূরানী আগস্ট মাসের ২৯ তারিখ ২০২৪, বৃহস্পতিবার ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। তিনি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে আইনি বৃত্তি এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে  গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রদান করেছেন। 

জন্ম এবং শিক্ষা 

মাজিদ নূরানী ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০ সালে  মুম্বাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি মুম্বাই শহরেই সেন্ট মেরি জেসুইট স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে, মুম্বাই সরকারি আইন কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রী হাসিল করেন। এবং ১৯৫৩ সালে বোম্বে হাইকোর্টে একজন আইনজীবী হিসাবে আপন কর্মজীবন আরম্ভ করেন।

১৯৬৫ সালে ভারত চীন যুদ্ধের সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর গ্রেফতারকৃত কিছু বিধি লঙ্ঘন করার জন্য প্রযোজ্য প্রতিরোধমূলক আটক আইনের অধীনে নূরানী সাহেবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, এবং তাকে ইয়ারওয়াদা কারাগারে পাঠানো হয়, এবং তিন বছর পর টিনাকে রেহায় করা হয়। 

অবদান 

ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য স্টেটসম্যান, দ্য হিন্দু, দৈনিক ভাসকার এবং দ্য ডায়নের মতো নেতৃস্থানীয় প্রকাশনাগুলিতে নূরানী সাহেব নিয়মিত নিজ লেখন পাবলিশ করতেন।

তিনি ফ্রন্টলাইন নামক ইংরেজী ম্যাগাজিনের  দীর্ঘমেয়াদী অবদানকারী, সাংবিধানিক এবং মানবাধিকার ইস্যুতে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণের জন্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলেন।

যদিও তিনি আইন অনুশীলন করতেন, তাই তিনি নিজের  বেশিরভাগ সময় আইনী, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়গুলিতে লেখার জন্য নিয়োজিত করতেন।  তিনি নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সাংবিধানিক বিষয়ে গভীর জ্ঞানের জন্য ভারতীয় রাজনীতি এবং আইনশাস্ত্রের একজন অনুসন্ধানী ভাষ্যকারে পরিণত হন। তিনার বইয়ের মধ্যে আর্টিকেল ৩৭০ এ কনস্টিটিউশনাল হিস্টোরি অফ জম্মু এন্ড কাশ্মীর (৩৭০ অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক ইতিহাস) বইটি কোর্টে কাশ্মীর ইস্যুতে চর্চা করার সময় ভারতের আদালতে সবচেয়ে উদ্ধৃত বই। 

ফ্রনলাইন ম্যাগাজিনে তিনার অবদান 

যাইহোক, ১৯৮০ এর দশকে ফ্রোনলাইন ম্যাগাজিন শুরু হওয়ার পর সেই ম্যাগাজিনের দ্বারায় আপন শ্রোতাদের নিজ বার্তা পৌঁছাতেন। সেই ম্যাগাজিনে "কনস্টিটিউশনাল কোয়েশ্চনস (সাংবিধানিক প্রশ্ন)" নামক একটি বিশেষ বিভাগে  তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জটিল আইনি সমস্যাগুলির সূক্ষ্ম গবেষণা এবং সুষম বিশ্লেষণে করে পাবলিশ করেন।

সেই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধের মধ্যে সাবারকার এন্ড দ্য বেজিপি, মোদি আস তুগলাক্ক, কাশ্মীর ডিসপিউট ওর ওয়ার্ল্ড ইস্যু, গভর্নর এ কলোনিয়াল রিলিক, কাশ্মীর মার্ডার অফ ইনসানিয়াত, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 

একজন লেখক হিসেবে নূরানী সাহেব ভারতীয় সাংবিধানিক আইন, রাজনীতি এবং ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে নানান বই লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে দ্যা কাশ্মীর কোয়েশ্চেনস (কাশ্মীর প্রশ্ন), মিনিস্টার মিসকন্ডাক্ট (মন্ত্রীর অপব্যবহার), কনস্টিটিউশনাল কোয়েশ্চেনস এন্ড সিটিজেনস রাইটস (সাংবিধানিক প্রশ্ন এবং নাগরিকদের অধিকার), দ্য আরএসএস: এ মেনেস টু ইন্ডিয়া (আর এস এস: ভারতের জন্য হুমকি), দ্য ডিস্ট্রাকশন অফ হায়দরাবাদ (হায়দরাবাদের ধ্বংস), ইসলাম এন্ড জিহাদ: প্রেজুডিস ভার্সেস রিয়েলিটি (ইসলাম ও জিহাদ: কুসংস্কার বনাম বাস্তবতা), দ্য বাবরি কোয়েশ্চেনস এ ম্যাটার অফ ন্যাশনাল অনড় (বাবরি মসজিদ প্রশ্ন: জাতীয় সমমানের বিষয়), চ্যালেঞ্জেস টু সিভিল রাইটস গ্যারান্টি ইন ইন্ডিয়া (ভারতে নাগরিক অধিকার গ্যারান্টির প্রতি চ্যালেঞ্জ), ইত্যাদি। 

তাঁর প্রায় সমস্ত লেখনেই সরকারী আধিপত্য এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবক্ষয় নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।

দর্শন 

এডভোকেট নূরানী মাজিদ নাগরিক স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক সমর্থনের জন্য করতেন।  তিনি আইনের একজন সোচ্চার সমালক ছিলেন, তিনি মনে করতেন যে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেমন প্রতিরোধমূলক আটক এবং মতপ্রকাশ স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ করা হয়েছে।

যদিও তিনি কখনও কোনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হননি কিন্তু তবুও আইনি ও রাজনৈতিক মহলে তিনার মতামত ও পরামর্শ বিশাল গুরুত্ব বহন করে।

পরলোকগমন 

এডভোকেট আব্দুল গফুর মাজিদ নূরানী ২৯ আগস্ট ২০২৪ বৃহস্পতিবার ৯৩ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে আপন রবের ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তিনার মৃত্যুতে কাশ্মীর সহ সমস্ত  দেশবাসী ব্যাপকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter