আবু বকর সিদ্দিক ( রহঃ)

মুজাদ্দিদে জামান মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি ফুরফুরা  সিদ্দিকী বংশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। মোজাদ্দেদে জামান ও আমিরুস শরিয়ত হিসেবে সমগ্র বিশ্বে তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আরবের  বাদশাহকেও  তিনি হেদায়েতী পত্র লিখেছিলেন। যার উত্তর আজও সযত্নে রক্ষিত আছে। বাংলা ভারতের  প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ-নসিহত, হাজার হাজার 
 মাদ্রাসা  প্রতিষ্ঠা, পত্র পত্রিকার প্রকাশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  বিস্তারে তার অবদান ইসলামী বিশ্বকোষে বর্ণিত হয়েছে।   
মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি ১৮৪৫ সালে হুগলি জেলার ঐতিহাসিক গ্ৰাম ফুরফুরা শরিফে পিতা আব্দুল মুক্তাদির সিদ্দিকীর ঘরে জন্ম গ্ৰহণ করে, এবং ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর  সিদ্দিকির  সরাসরি বংশধর, তিনি সবার কাছে দাদা হুজুর পীর কেবলা নামে পরিচিত ।
শিক্ষা ও সাধনা
কোরআন হাদিস শিক্ষা :
সে যুগে মুসলমানদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তথাপিও আত্মীয় স্বজনদের উৎসাহে শাহ আবুবকর (রঃ) স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু মহান প্রভুর ইচ্ছা ছিল, তাঁকে দিয়ে স্বীয় দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার।
এক রাত্রে বালক আবুবকর (রঃ) স্বপ্ন দেখেন, একজনের জানাজা উপলক্ষে বহু ওলীআল্লাহ সেই সাথে স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) উপস্থিত হয়েছেন। বালক আবু বকরও ঐ জামাতে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতে,নবী পাক (সাঃ) বললেন, “যদি তুমি এই জামাতে শরীক হতে ইচ্ছা কর তাহলে যে শিক্ষা তুমি অর্জন করেছ তাহা ত্যাগ করো"।]
সুতরাং এই শিক্ষা ত্যাগ করে ফুরফুরার নিকটবর্তী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিতাপুর মাদ্রাসায়(১৭৭২) ভর্তি হন। এখানের পড়াশোনা শেষ করে হুগলি সদর শহরের মুহসিনিয়া মাদ্রাসা থেকে তৎকালীন সর্বোচ্চ জামাতে উলা ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন]। অতঃপর কলকাতায় গমন করতঃ সিন্দুরিয়া পট্টি (অধুনা কলুটলা, কলকাতা) মসজিদে জামালুদ্দিন শিক্ষা কেন্দ্রে হাফিজ জামালুদ্দিন মুঙ্গেরী (রহঃ) এর নিকট হাদীস, তফসির ও ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যায়ন করেন।হাফেজ জামাল উদ্দিন ছিলেন তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহঃ)এর খলিফা। বালাকোট যুদ্ধে তিনি নিজ পীরের সঙ্গী ছিলেন।হেকমত, মান্তিক বা দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন ফিরিঙ্গি মহলের নজর শাহ বেলায়েতী (রহঃ) এর কাছে। তখন তিনি কলকাতার নাখোদা মসজিদে অবস্থানরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে ধারাবাহিক ভাবে দীর্ঘ ১৮ বছর ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার মধ্যে অতিবাহিত করেন। উল্লেখ থাকে যে, আবু বকর সিদ্দিকীর ছিল নিজস্ব একটি লাইব্রেরী। যাতে ছিল বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসমূহ। যেটি বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফুরফুরা টাইটেল মাদ্রাসার(১৯০২) সঙ্গে যুক্ত।
১৮৯২ সালে তিনি মক্কা ও মদিনা গমন করেন। মদীনা শরীফে কিছু কম এক বছর অবস্থান করে মদিনার তৎকালীন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শাইখুদ্ দালায়েল সৈয়দ মোহাম্মদ আমিন ইবনে আহমাদ ইবনে রেদওয়ান মাদানীর নিকট 40 টি হাদিস গ্রন্থের সনদ লাভ করেন ।

উনিশ শতকের শেষার্ধের দিনগুলি ছিল মুসলমানদের জন্য চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগের দিন, ফারয়েজী ও ওয়াহাবী বা তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনের তীব্রতা তখন প্রশমিত। একদিকে ক্ষমতার শীর্ষে ইংরেজ, তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করেছে জাতীয় উন্নতি, অবনতি। ভাষাগত দ্বন্দ্বের সাথে সাথে স্বজাতি বিজাতীর মধ্যে ছিল ধর্মগত বিরােধ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত।
ইসলামের সঠিক ধর্মমত নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে শীয়া সুন্নি, হানাফী,মােহাম্মাদী, বেদাতী পীর-ফকির, কাদিয়ানী বিরােধের পাশাপাশি খৃষ্টান, আৰ্য্য,বাউলদের প্রচার ও প্রভাবে মুসলিম সমাজ ছিল উভ্রান্ত। 
“এই সময় বাংলাদেশের নানা জেলা থেকে খবর আসে, মুসলমানেরা খ্রীষ্টান, ব্রাহ্ম ও হিন্দু ধর্ম অবলম্বন করছেন।যশােহর জেলায় কিছু সংখ্যক মুসলমান কারিগর খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে হাটে মাঠে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করে বেড়ায়। চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটে , খুলনায় ও সাক্ষীরা মহকুমায় কতিপয় মুসলমান ব্রাহ্ম ধর্ম অবলম্বন করে। এমন খবরও প্রকাশিত হয় যে, রংপুর জেলায় কিছুসংখ্যক মুসলমান “খােল করতাল যােগে হরি সংকীৰ্ত্তন করে নিরামিষ খায়। তাহাদের মধ্যে মুসলমানের কোন কিছু দৃষ্ট হয় না।” 
তাছাড়া নানা দেশাচার কুসংস্কারে ও শিক্ বিদআতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিল মুসলিম সমাজ, শিক্ষার আলাে বলতে যা ছিল তা হলাে অপ্রতুল অতিক্ষুদ্রকায় শ্রেণীর মধ্যেই  সীমাবদ্ধ। মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক দিকের পর্যালােচনায় এটি খুবই স্পষ্ট যে, সবদিক থেকেই যুগটি ছিন্নপতনের যুগ। অথচ ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র কাওমী মাদ্রাসা আধ্যাত্মিক অনুশীলন কেন্দ্র খানকা ছিল না তা নয়।

সমকালীন অবিভক্ত বঙ্গ আসামে এমন সব উলামা লক্ষ্য করা যায়,আজকের দিনে ভারতে যেরূপ বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তি দুর্লভ বললে অত্যুক্তি হবে না। যেমন – শামসুল উলামা পীর হযরত গােলাম সালমানী (রঃ) (মৃঃ১৯১২) ইসলামিক দর্শন শাস্ত্রের, পণ্ডিত, আল্লামা, লুতফর রহমান বর্ধমানী(রঃ) (মৃঃ ১৯২০-২১) হাদিসতত্ববিদ, আল্লামা, এসহাক বর্ধমানী (রঃ) (মৃঃ১৯২৮) শ্রেষ্ঠ ফকিহ, আল্লামা, বেলায়েত হােসেন কলকাতাবী (১৮৬৪ -১৯২২) আরবী সাহিত্যের পণ্ডিত, আল্লামা, বেলায়েত হােসেন বীরভূমী (১৮৮৭) (রঃ), মুহাদ্দিস, আল্লামা, আবদুল ওয়াহেদ চাটগামী (রঃ) (মৃঃ১৯১০), আল্লামা মুহাম্মদ মঙ্গলকোটি বর্ধমানী (রঃ) (মৃঃ ১৯০৭), চট্টগ্রামের বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ হাসান ওরফে মুহাদ্দিস সাহেব (রঃ) (মৃঃ১৯২০), আল্লামা মুহাম্মদ তাহের সিলেটি (রঃ) (মৃঃ ১৯৪০), এমন অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিতগণের নাম জানা যায়। এই সকল উলামারা মাদ্রাসায় শিক্ষাদানে রত ছিলেন। অনেকে উর্দু ও আরবী বই-পুস্তকও রচনা করেন। কেউ কেউ পীরও ছিলেন, যেমন শামসুল উলামা গােলাম সালমানী (রঃ)। ফুরফুরার শাহ 

আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)'র সাথে তার কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক নয়, উভয়ের মধ্যে ছিল নিবিড় এক আত্মিক যােগসূত্র। গােলাম সালমানী (রঃ) বয়সে বড় ছিলেন বলে, শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) তাকে বড় ভাই বলে সম্বােধন করতেন। উভয়ে ছিলেন শাহ সুফী ফতেহ আলী (রঃ)’র খলিফা! শাহ গােলাম
সালমানী (রঃ) এই বলে তাঁকে দুয়া করতেন; আল্লাহ আমার ভাই শাহ আবুবকর (রঃ) দ্বীনের প্রচার করছেন, আমার হায়াত কম করে দিয়ে তাঁর হায়াতে বরকত দান করবেন। গােলাম সালমানী (রঃ) যেমন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন, অনুরূপ একজন পীর মুর্শিদও ছিলেন।আল্লামা আবদুল আউওয়াল জৌনপুরী (রঃ) (১৮৬৬-১৯২১) মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০ - ১৮৭৩) (রঃ)’র কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত, উর্দু, আরবী ও ফারসী ভাষায় ১২১টি পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেন। যেসব ছােট-বড় পুস্তক-পুস্তিকা এবং গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে ৮৭টি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৪৫টি আরবীতে, ৪০টি উর্দুতে দু'টি ফার্সীতে।তার বৃহৎ গ্ৰন্থ ‘মুফীদুল মুফতী’ ২৮৬ পৃষ্ঠার।  
শিক্ষার অবদান :
তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১১০০ মাদরাসা এবং ৭০০ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আল্লাহ পাক বলেন “যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ প্রিয়পাত্র রূপে মনােণীত করেন, এবং যে অতি আগ্রহের সাথে তাঁর অভিমুখী হন, তাকে তিনি স্বীয় নৈকট্যের পথ দেখান।”
কুরআনের এই আয়াতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের দুটি পথ উল্লেখ হয়েছে 'জাজবী' ও 'সুলুুক'।
কোন, কোন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ জজবা’ ও ‘সুলুক’ উভয় পর্যায়ের মর্যদা দান করে থাকেন। আল্লাহ পাকের বিশেষ কল্যাণহেতু হযরত শাহ পীর আবু বক্কার সিদ্দিকী (রহঃ) এই মর্যাদায় বিভূষিত হন। ছাত্রজীবনে হুগলি মাদ্রাসায় থাকাকালীন তাঁর আধ্যাত্মিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় যে, অধিকাংশ রাত্রে তাঁর অন্তরের সাথে চার তরিকার নিসবত বা এক ধরনের যোগসুত্র ঘটতো। এই যোগসুত্র যখন যে তরিকার সাথে হতো তখন তিনি অধীর হয়ে ওই তরিকার জিকির করতেন।
অনেক সময় একটি নূর বা জ্যোতি দ্বারা তাঁর আপাদ-মস্তক আচ্ছাদিত হয়ে পড়ত এবং তাঁর আত্মবিস্মৃত ঘটতাে। শাহ আবুবকর (রঃ) প্রথম জীবনে, জনমানব শূণ্য ময়দানে যিকরে জলীর (উচ্চস্বরে যিকর) বহু বহু রাত্রি অতিবাহিত করেন। এককথায় ছাত্রজীবন থেকেই তার জাজবী অবস্থার সাথে সাথে কৃচ্ছ্র সাধনাও শুরু হয়েছিল।
এরপরও তিনি সমকালীন শ্রেষ্ঠ সাধক শাহ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর নিকটে বায়'আত হন। তাঁর সান্নিধ্যে চার তরিকার নিয়ম নীতি অনুযায়ী অনুশীলন পূর্বক খিলাফত লাভ করেন। পীরের ভালোবাসায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর কোলে মাথা রেখেই শাহ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
সময়টা ছিল ১৩০৪ হিজরী ৮ই রবিউল আউয়াল । ইং ১৮৮৬ রবিবার । বেলা ৪ ঘটিকা।
আল্লাহ পাক বলেন “যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ প্রিয়পাত্র রূপে মনােণীত করেন, এবং যে অতি আগ্রহের সাথে তাঁর অভিমুখী হন, তাকে তিনি স্বীয় নৈকট্যের পথ দেখান।”
কুরআনের এই আয়াতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের দুটি পথ উল্লেখ হয়েছে 'জাজবী' ও 'সুলুুক'।
কোন, কোন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ জজবা’ ও ‘সুলুক’ উভয় পর্যায়ের মর্যদা দান করে থাকেন। আল্লাহ পাকের বিশেষ কল্যাণহেতু হযরত শাহ পীর আবু বক্কার সিদ্দিকী (রহঃ) এই মর্যাদায় বিভূষিত হন। ছাত্রজীবনে হুগলি মাদ্রাসায় থাকাকালীন তাঁর আধ্যাত্মিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় যে, অধিকাংশ রাত্রে তাঁর অন্তরের সাথে চার তরিকার নিসবত বা এক ধরনের যোগসুত্র ঘটতো। এই যোগসুত্র যখন যে তরিকার সাথে হতো তখন তিনি অধীর হয়ে ওই তরিকার জিকির করতেন।

অনেক সময় একটি নূর বা জ্যোতি দ্বারা তাঁর আপাদ-মস্তক আচ্ছাদিত হয়ে পড়ত এবং তাঁর আত্মবিস্মৃত ঘটতাে। শাহ আবুবকর (রঃ) প্রথম জীবনে, জনমানব শূণ্য ময়দানে বহু রাত্রি আল্লাহর যিকিরে  অতিবাহিত করতেন। এককথায় তিনি ছাত্রজীবন থেকেই আল্লাহর সাধনা শুরু হয়েছিল।

এরপরও তিনি সমকালীন শ্রেষ্ঠ সাধক শাহ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর নিকটে বায়'আত হন। তাঁর সান্নিধ্যে চার তরিকার নিয়ম নীতি অনুযায়ী অনুশীলন পূর্বক খিলাফত লাভ করেন। পীরের ভালোবাসায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর কোলে মাথা রেখেই শাহ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
সময়টা ছিল ১৩০৪ হিজরী ৮ই রবিউল আউয়াল । ইং ১৮৮৬ রবিবার । বেলা ৪ ঘটিকা। 17 মার্চ 1939 সালে 93 বয়সে মারা যান।  

Related Posts

Leave A Comment

1 Comments

Voting Poll

Get Newsletter