ইমাম ইবনুল আসাকির: দিমাশকের জ্ঞানের সূর্য ও ইসলামী ইতিহাসের মহাগ্রন্থকার
ভুমিকা:
ইসলামী ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক আলেমের নাম আছে, যাঁদের জ্ঞান, সাধনা ও অবদান সভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম আল-হাফিজ আবু আল-কাসিম আলী ইবনু আল-হাসান ইবনু হিবাতুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনুল আসাকির আদ-দিমাশকি আশ-শাফি'ই (রহঃ) — যিনি সংক্ষেপে পরিচিত “ইবনুল আসাকির” নামে। তিনি ছিলেন এমন এক আলেম, যিনি দিমাশক তথা সমগ্র শাম অঞ্চলে ইসলামী জ্ঞান ও ইতিহাস রচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারীখু দিমাশক’ (দামেস্কের ইতিহাস) ইসলামি ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থগুলোর একটি।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন :
ইবনুল আসাকির ১১০৫ খ্রিষ্টাব্দে (৪৯৯ হিজরি) দিমাশকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল শিক্ষিত, ধার্মিক ও আলেমদের পরিবার। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় অনুরাগ, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি, যিনি ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষায় উৎসাহিত করেন। কিশোর বয়সেই তিনি কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন এবং আরবি ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন তাঁর নিজের পিতা ও দিমাশকের বিখ্যাত মুহাদ্দিসরা। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল জ্ঞানের প্রতি এক অদম্য তৃষ্ণা — যা পরবর্তী জীবনে তাঁকে ইসলামী ইতিহাসের মহীরুহে পরিণত করে।
শিক্ষাযাত্রা ও জ্ঞান অন্বেষণ :
ইবনুল আসাকির শুধু দিমাশকে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি জ্ঞানের সন্ধানে হিজাজ, ইরাক, খোরাসান, বাগদাদ, নীশাপুর, ইসফাহান, হামদানসহ বহু শহর ভ্রমণ করেন। তাঁর শিক্ষাগুরুদের সংখ্যা প্রায় ১,৩০০ জনেরও বেশি। তিনি প্রত্যেকের কাছ থেকে হাদীস শোনেন, লিখে রাখেন ও সংরক্ষণ করেন।
তিনি হাদীসের isnād (বর্ণনাশৃঙ্খলা) যাচাইয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাঁর সময়কার মুহাদ্দিসরা বলতেন, “যদি কোনো হাদীসের বর্ণনাশৃঙ্খলা নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে ইবনু আসাকিরের কাছে যাও, কারণ তাঁর নিকটে সত্যতা লিপিবদ্ধ আছে।”
তাঁর ভ্রমণ ও অধ্যয়নকাল প্রায় ৪০ বছরব্যাপী ছিল, যা তাঁকে তাঁর সময়ের সর্বাধিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করে।
হাদীস ও ইতিহাসে তাঁর অবদান :
ইমাম ইবনু আসাকিরের সবচেয়ে বড় অবদান হলো তাঁর বিশাল ইতিহাসগ্রন্থ “তারীখু মাদিনাতি দিমাশক” (দামেস্কের ইতিহাস)। এটি শুধু একটি শহরের ইতিহাস নয়, বরং ইসলামী সভ্যতার এক বিশ্বকোষ। প্রায় ৮০ খণ্ডের এই গ্রন্থে তিনি দিমাশকের সাহাবি, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, আলেম, ফকীহ, সুফি, সাহিত্যিক, কবি ও প্রশাসকদের জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন।
তিনি শুধু জীবনী লিখেননি; বরং প্রতিটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চরিত্র, ও হাদীস বর্ণনার শৃঙ্খলাও সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর এই কাজের জন্য পরবর্তী যুগে ইতিহাসবিদরা তাঁকে “ইসলামী জীবনী সাহিত্যের ইমাম” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তাফসির, ফিকহ ও আখলাকচর্চা :
যদিও ইবনুল আসাকির মূলত হাদীস ও ইতিহাসের আলেম হিসেবে পরিচিত, তিনি একই সঙ্গে শাফিঈ মাজহাবের ফকীহও ছিলেন। ফিকহে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা তাঁকে দিমাশকের প্রধান বিচারকদের উপদেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
তিনি তাফসিরেও পারদর্শী ছিলেন, আরব ব্যাকরণ ও বাগ্মিতায় ছিলেন অগ্রগণ্য।
আখলাক ও তাসাউফ নিয়েও তিনি বহু বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলতেন,
> “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে, কিন্তু বিনয় হারায়, সে জ্ঞানের নয়, বরং অহংকারের গোলাম।”
তাঁর লেখনী ও অন্যান্য গ্রন্থসমূহ :
“তারীখু দিমাশক” ছাড়াও ইবনুল আসাকির প্রায় ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কিছু হলো—
তাবইনু কিযবিল মুপ্তারি ফি মা নুসিবা ইলা আল-ইমাম আবিল হাসান আল-আশআরি
(আশআরী আকীদাহর পক্ষসমর্থনে রচিত এক মহান গ্রন্থ)
আল-আরবাঈন ফি ফাদাইলি আহলিল বায়ত
আল-মুযাক্কার ফি ফাযাইলিল আনসার
আল-ফাযাইলুল মুজমা ‘আলাইহা
এই গ্রন্থগুলো তাঁর বিস্তৃত জ্ঞান, বিশুদ্ধ আকীদা ও উম্মাহর ঐক্যের প্রতি ভালোবাসার পরিচায়ক।
তাঁর চরিত্র, আখলাক ও জীবনধারা :
ইবনুল আসাকির ছিলেন এক বিনয়ী, সংযমী ও নিরহংকারী মানুষ। তিনি কখনো নিজের জ্ঞানকে গর্বের বস্তু বানাননি; বরং বলতেন —
“আমি যত বেশি শিখি, তত বেশি উপলব্ধি করি আমি কত কম জানি।”
তিনি রাত্রির অধিকাংশ সময় ইবাদতে কাটাতেন, দিনে শিক্ষাদান ও লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন। বলা হয়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন হাদীস অধ্যয়ন বন্ধ করেননি।
দিমাশকের সমাজে তাঁর প্রভাব :
তাঁর জীবদ্দশায় দিমাশক ছিল ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র। ইবনুল আসাকির সেই কেন্দ্রের হৃদয় ছিলেন। তাঁর চারপাশে শত শত ছাত্র ও গবেষক জড়ো হতো। তাঁর শিষ্যদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে বহু খ্যাতনামা আলেম বেরিয়ে আসেন।
ইবনু আসাকিরের সময়কালেই দিমাশকে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল — বিশেষ করে আশআরী ও সালাফী মতের অনুসারীদের মধ্যে। কিন্তু ইবনুল আসাকির তাঁর প্রজ্ঞা, যুক্তি ও দাওয়াতের মাধ্যমে এই মতবিরোধকে একাত্মতার পথে আনেন। তাঁর গ্রন্থ “তাবইনু কিযবিল মুপ্তারি” এই ঐক্য রক্ষার এক উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে তিনি যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে আহলুস সুন্নাহর মতকে রক্ষা করেন, কিন্তু কারও প্রতি অপবাদ বা বিদ্বেষ ছড়াননি।
তিনি সমাজে আলেমদের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করেন। তাঁর উপদেশে মানুষ বুঝতে শিখেছিল যে জ্ঞান অর্জন কেবল ব্যক্তিগত গৌরব নয়, বরং সমাজ সংস্কারের একটি আমানত। তিনি দিমাশকের বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্মীয় আলোচনায় নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার গুরুত্ব আরোপ করেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও হাদীস পাঠচক্র শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামী শিক্ষার ধারক হিসেবে কাজ করেছে।
ইন্তেকাল ও উত্তরাধিকার :
ইমাম ইবনুল আসাকির ১১৭৬ খ্রিষ্টাব্দে (৫৭১ হিজরি) দিমাশকে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৭১ বছর। তাঁকে তাঁর প্রিয় শহর দিমাশকেই দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যু দিমাশকের মানুষ গভীর শোকের সঙ্গে পালন করে। কারণ, তারা জানত, একজন আলেম নয়—একটি যুগ হারিয়ে গেল। আজও ইসলামী গবেষণা ও ইতিহাসচর্চায় “তারীখু দিমাশক” একটি অপরিহার্য উৎস, আর ইবনু আসাকিরের নাম উচ্চারিত হয় গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে।
উপসংহার :
ইমাম ইবনুল আসাকির ছিলেন কেবল একজন ইতিহাসবিদ বা মুহাদ্দিস নন; তিনি ছিলেন এক “চিন্তার বিপ্লবী,” যিনি ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি শাখাকে তাঁর কলম ও কর্মের মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তিনি এমন এক যুগে বসবাস করতেন, যখন ইসলামী সভ্যতা জ্ঞান ও রাজনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কলমের শক্তি তলোয়ারের চেয়েও স্থায়ী।
তাঁর রচিত ‘তারীখু দিমাশক’ কেবল ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহ নয়; এটি ইসলামী সংস্কৃতি, সমাজ, ও মানবচরিত্রের এক জীবন্ত দলিল। তাঁর লেখনিতে আমরা দেখি কিভাবে একজন আলেম ইতিহাসের মাধ্যমে উম্মাহর ঐক্য ও আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন।আজকের দিনে যখন জ্ঞানের চর্চা অনেক সময় বাহ্যিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তখন ইবনুল আসাকির আমাদের শেখান —
“জ্ঞান মানে কেবল জানা নয়, বরং সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার এক পবিত্র দায়িত্ব।”