ঈদুল আযহা: ত্যাগ ও খুশির উৎসব
আরবীতে একটি কথা খুব প্রচলিত আছে "যুর গিববান তাজদাদ হুব্বান" অর্থাৎ একদিন পর পর সাক্ষাৎ করো তাহলে ভালোবাসা বাড়বে। কথাটির প্রমাণ দেওয়ার বোধহয় প্রয়োজন হবেনা, আমি যা বলতে চাইছি তা হলো ইসলামের দুটি মহা উৎসব, যার উৎযাপনের ক্ষেত্রে আমরা কোনোরকম কমতি রাখিনা। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। একটি নিয়ে আসে ভালোবাসা, প্রেম, আবেগ আর সারা বছরের লুকানো অনূভূতি ও খুশি, আর অপরটিতে প্রকাশ পায় আল্লাহর প্রতি মানুষের আত্মত্যাগ, আস্থা ও ইসলামের উজ্জলিত চিত্র।
ঈদুল আযহা:
ঈদ কথাটাই শুনলে সেই ছোট্টকালের কথা খুব তাড়াতাড়ি স্মরণ চলে আসে, আমারও তাই, কিন্তূ ঈদুল আযহার ব্যাপারটা একটু অনেক গুরুতর ও উজ্জ্বল হয়ে ভেসে আসে। সেই আব্বাজানের ঈদের পর সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে আসার জন্য আমাকে ডাকা, যবেহের আগে বাড়ি থেকে বাগান বারবার ছোটাছুটি, চাকুতে হাথ দিলে আব্বার বরণ করা, আর যবেহের পর মাংস কাটতে গেলেই এই শুনে থমকে যাওয়া যে হাথ কেটে যাবে, তারপর তো আসে বণ্টনের সময়, বাড়ি বাড়ি শুধু দৌড় দিতাম মাংসের সেই কিছু অংশ নিয়ে, জানতাম না সেই সময় কিছুই কিন্তু এখন অল্প বুঝছি যে ওই সবের সাথে মেশা আছে ভালোবাসা, আবেগ, প্রেম, আত্মত্যাগ আর ইসলামের আসল ছবি।
হ্যাঁ, এটা হলো একরকম অনুভুতি যা পাতায় তোলা যায়না, এর স্বাদ সেই বলতে পারবে যে এটা পালন করে, সেই পারবে অনুভব করতে যে আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগ করেছে, হৃদয় কে এই চারদিন তার তাকবীর তাহলীল আর যিকিরে যে ব্যক্তি ডুবিয়ে রাখবে সেই স্বর্ণকারই পারবে স্বর্ণের আসল মর্ম বুঝতে।
এটা হলো আত্মত্যাগের দিন:
এই দিনে বিশেষ করে ইব্রাহিম (আ:)-এর আল্লাহর জন্য ত্যাগের সেই চিত্র পুনর্জীবন পায়। ইব্রাহিম (আ:) এত বাঁধা-বারণ থাকা সত্বেও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা আর ত্যাগের প্রতীক। এই দিন এক ওপরের সাহায্য করে সবাই মিলে একত্রিত হয়ে আল্লাহর সামনে মাথা নত করার পর তিনার নামে পশু কোরবানী করা আর সেই মাংসের অংশ এক ওপরের মধ্যে বণ্টন করার মধ্যে পায় ইসলামের সুন্দর এক পরিচয়।
অবশ্যয় ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ:)-এর সেই আন্তরিক ত্যাগ ও ভালোবাসা চিত্রছবি ভোলা অসম্ভব। খুব ছোট ছিলাম আমি যখন প্রথম এই আত্মত্যাগের কাহিনীটা আব্বা আর আমি একসঙ্গে একটা বইয়ে পড়েছিলাম। ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ:)-কে সেই দিন কুরবানী দেওয়ার আগে রাস্তায় অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় কিন্তূ তিনাদের মধ্যে ছিল বিশ্বাস। আর উল্লেখযোগ্য কথা হলো যে এই ত্যাগে বিশ্ব নবীজীর তাঁর বংশে আগমনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন লুকিয়েছিল।
যাইহোক, ঈদের এই খুশির দিনে আমরা খুব জমজমিয়ে কাটায়। কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আছে কিছু আবেগভরা আর দুঃখজনক কথা। আজ আমাদের দেশে ও সমাজে এই দিনটিকে ইব্রাহিম (আ:)-এর সুন্নতের মতো না কাটিয়ে লেগে পড়েছি পৃথিবীর বিভিন্ন লোভ লালসা ও জাঁক জমকে রাঙিয়ে দিতে। যেখানে আমাদের আত্মত্যাগ আত্মা পরিশুদ্ধির কথা উঠছে সেখানে পশু নিয়ে এত দ্বন্দ্ব কিসের? কিসের এত অহংকার? আপনি কি জানেন না যে আল্লাহর কাছে আপনাদের পশুর মাংস বা রক্তটা বড়ো কথা নয় বরং সর্বোপরি আপনার হৃদয়ে কি নিয়ত লুকিয়ে আছে সেটাই বড়ো কথা।
আর এই খুশির দিনের শুভেচ্ছা প্রকাশ করার ব্যাপারটা তো উল্লেখযোগ্য। আজকাল মনে হচ্ছে সোশ্যাল প্লাটফর্ম গুলোই ঈদ উদযাপন করছে আর আমরা কম্পিউটার এর মতো মৃত যন্ত্র হয়ে সারাক্ষণ এই প্রসেসটা সম্পূর্ণ করতে ব্যস্ত আছি। বাড়ির পাশের চাচা, দাদা, দাদুদের ঈদের সালাম ও অভিনন্দন দেওয়া হয়েছে তার খেয়াল নেই বরং মেতে আছি আমেরিকার, আরবের সেই দুদিনের ফেসবুক ফ্রেন্ডসদের মন ভরে ঈদের অভিনন্দন দিতে। ঈদের দিন নামাজের পর আম্মু আব্বুর হাত দুটোতে চুমু দিয়ে একবার সালাম করে তো দেখ, যেন সারাজীবনের খুশি তোমার মধ্যে একমুহূর্তে ভুল করে চলে আসবে।
যাইহোক, অবশেষে এটা আবারও বলবো যে ঈদুল আযহা হলো একটি উৎসব, পরীক্ষা ও অনেক বড়ো নিয়ামত, তাই আমাদের এই দিনটাকে সম্পূর্ণরূপে সফলতা ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করে বিদায় দিতে হবে। সবাইকে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো। সালাম।