মালদার ঐতিহ্য - পান্ডুয়া শরীফ

পান্ডুয়া যা আমরা এখন এক ছোট্ট গ্রামের আকারে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সেটি ইতিহাসে হযরত পান্ডুয়া নামে পরিচিত।  ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর। পান্ডুয়া এখন প্রায় সমার্থকভাবে ইংরেজ বাজারের (বা মালদা টাউন) প্রায় 18 কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি ছোট শহর যা আদিনা নামে পরিচিত। এই সেই জায়গা যেখানে শুয়ে আছেন হুজুর জালালুদ্দীন তাবরীজী (রাহঃ) ও মুর্শিদে মাখদুম সিমনানী আলাউল হক পান্ডবী (রাহঃ)-এর মত বড়ো বড়ো  আল্লাহর প্রিয় বান্দারা। এই সেই জায়গা যেখানে এককালে "শাহী বাংলা" (সুলতানে বেঙ্গল) রাজত্বের রাজধানী ছিল।আর সেই ভূমিতে শায়িত আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুরশিদে মাখদুম আশরাফ সিমনানী, গাঞ্জে নাবাত হুজুর আলাউল হক লাহরী পান্ডবী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি জীবন যাপন করছেন।

হুজুর আল-উল-হক, আহমদ নামেও পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর ডাক-নাম গঞ্জ-ই-নবাত। তিনি ছিলেন বাংলার  চৌদ্দ শতকের একজন ইসলামিক পন্ডিত ও আল্লাহর ওলী।

 তিনি ছিলেন হুজুর আখি সিরাজ (রাহঃ)-এর  সিনিয়র শিষ্য এবং উত্তরসূরী (খালিফা) যিনি মালদার গৌড়ে পিরানা পির দরগায় শায়িত।

হুজুরের জন্ম "হযরত পান্ডুয়া"(ধ্বংসপ্রাপ্ত) শহরে একটি মুসলিম পরিবারে হয়েছিল। তিনি খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ (রাঃ)-এর বংশধরের উত্তরসূরি। খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ (রাঃ) ছিলেন প্রসিদ্ধ একজন আরব সেনাপতি এবং ইসলামী নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর সহচর বা সাহাবী, যাকে তাঁর বীরতার জন্যে সাইফুল্লা উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর পিতা উমর ইবনে আসাদ খালিদি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরে লাহোর থেকে পান্ডুয়ায় চলে আসেন।

কিছু সূত্র দাবি করেছে যে হুজুর আলাউল হক রাহমাতুল্লাহ আলাইহি প্রথমে নিজামুল হক শরফির নিকট শিক্ষা লাভ করতেন, যিনি লখনৌতির (বর্তমান নাম গৌড়) ভিত্তিক বাংলার সিনিয়র পন্ডিত এবং নাসিরুদ্দিন বাহতের শিক্ষক ছিলেন।

এই দাবীটি অবশ্য সময়সীমার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলির কারণে সন্দেহজনক। তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে, হুজুর আলাউল হক অন্য ৮০০০ টাকার মূল্যবান দুটি বাগান উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত করেছিলেন যদিও অন্য কেউ এটি দখল করে নিয়েছিল। হুজুর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেননি।

পড়াশুনায় দক্ষতার সাথে আলাউল হক নিজেকে গঞ্জ-ই-নবত বলা শুরু করেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়া এই বিষয়টি সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তাঁর শিক্ষক ছিলেন গঞ্জ-ই-শকর (চিনির ভাণ্ডার), এবং গঞ্জ-ই-নবত (উপকারী চিনির ভান্ডার) উপাধিটি আলাউল হক (রাহঃ)-কে একরকম শ্রেষ্ঠত্ব দেখাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল । চিশতী আদর্শের আখি সিরাজ তাঁর শিক্ষক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পরামর্শে বাংলায় পৌঁছেছিলেন, সেখানে তাঁকে বাংলার আদালত পন্ডিত (কাজী) নিযুক্ত করা হয়। হুজুর আলাউল হক (রাহঃ) তাঁর ছাত্র হয়ে গঞ্জ-ই-নবত খেতাব বাদ দেন। তাঁর পরামর্শদাতা সিরাজের সাথে হুজুর পান্ডবীর   সম্পর্কিত অনেক গল্প আছে। কথিত আছে যে পান্ডবী (রাহঃ) তাঁর শিক্ষকের সাথে মাথায় কলসী নিয়ে খালি পায়ে একটি চুলা বহন করতেন যাতে তাঁর শিক্ষক গরম খাবার খেতে পারেন। সিরাজ তাঁর ছাত্রকে এতটুকু প্রশংসিত করেছিলেন যে তিনি তাঁকে তাঁর উত্তরসূরি করেছিলেন এবং তাঁর মেয়েকে হুজুর আলাউল হক-এর সাথে বিবাহ করিয়ে ছিলেন।

হুজুর সিরাজের মৃত্যুর পরে হক সাহেব আদালতের পণ্ডিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হজরত পান্ডুয়ায় খানকাহ স্থাপন হয়। তিনি বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সরকারের অভিজাত সদস্য হয়ে ওঠেন। সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকালে হুজুরকে বঙ্গীয় সালতানাতের রাজকোষের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

বুজরুকদের (কিংবদন্তি) অনুসারে হুজুর আলাউল হক তাঁর ছাত্র এবং অভাবীদের পক্ষে এত উদার মনের ছিলেন যে সুলতানের চেয়ে তাঁর উদারতা ছড়িয়ে যায়। ফলে, হুজুর আলাউল হককে তাঁর খানকায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে দু'বছরের জন্য সোনারগাঁয়ে নির্বাসনের ঘোষণা করা হয়েছিল।আধুনিক কালের ইরানের সেমনানের প্রাক্তন শাসক আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানী পান্ডুয়ায় আলাউল হকের ছাত্র হওয়ার জন্য তাঁর সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর যাত্রায় দু'বছর লেগেছিল এবং পান্ডুয়ার উপকণ্ঠে হুজুর আলাউল হক ও তাঁর শিষ্যদের সাথে সাক্ষাত করার পরে সেমনানীকে  পালকি দ্বারা হুজুর আলাউল হকের খানকায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাঁকে হুজুর আলাউল হক চার মুঠো চাল এবং পান খাওয়ান। হুজুর আলাউল হক (রাহঃ) হুজুর সিমনানীকে খানকাহে  গ্রহণ করার পরে শিক্ষার্থী আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানী আবৃত্তি করেন একটি ফারসি‌ কবিতা।

تاج دولت بر سر من، علاء الحق والدین گنج نبات

-আলাউল হক গঞ্জ-ই-নবাত আমার মাথায় দাওলাতের মুকুট স্থাপন করেছেন।

সেমননী ১২ বছর ধরে আলাউল হকের অধীনে পড়াশোনা করেছিলেন, তার পর তাঁকে জৌনপুরে গিয়ে প্রচার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

তাঁর শিষ্যদের মধ্যে তাঁর পুত্র নূর কুতুবে আলম পাণ্ডবী এবং সুফি সাধক আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানি অন্তর্ভুক্ত।

আবদুল হক আল-দেহলভী তাঁর 'আখবর আল আখিয়ার'-এ এই পরামর্শ দিয়েছেন যে, হুজুর আলাউল হক (রাহঃ) ৮০০ হিজরিতে (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে, হকের মাজারের অভিভাবকগণ একটি বই হাতে পেয়েছেন যা তাঁর মৃত্যুর উদ্ধৃতি দেয় ৭৮৬ হিজরিতে (১৩৮৪ খ্রি।) বলা হয় যে হুজুর আলাউল হকের জানাযা সৈয়দ জাহানিয়া জাহাঁ আলবুখারী দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল। তাঁর মাজার, ছোট দরগাহ, বাংলার অন্যতম প্রধান দরগাহ; মালদার ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হজরত পান্ডুয়ায় অবস্থিত এবং এর সংলগ্নে শায়িত আছেন বাংলার অন্যান্য সমসাময়িক পণ্ডিত যেমন জালালউদ্দিন তাবরিজী,আলাউল হকের নাতি বদরে ইসলাম এবং তাঁর নাতি শায়খ জাহিদ যিনি সোনারগাঁয়ের বিশিষ্ট আলেম ছিলেন।হুজুর আলাউল হক রাহমাতুল্লাহ আলাইহির মৃত্যুবার্ষিকী মালদহের পান্ডুয়া শরীফ দরগায় রজবের (আরবি মাস) ২৩, ২৪ এবং ২৫ তারিখে পালিত হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে‌ তিনার ভক্তরা হাজির হন।

হুজুরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

নাম: শায়খ আল-মুনিম আল-মুকাররম আলাউল হক ওয়াদ-আদ-দান পান্ডাবী

উপাধি: গঞ্জ-ই-নবাত

জন্মস্থান: হযরত পান্ডুয়া, বেঙ্গল সুলতানি (বর্তমানে মালদা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)

ধর্ম:  সুন্নী ইসলাম

পিতা: উমর বিন আসাদ খালিদি

মাযহাব:  হানাফী

বংশ: খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ,

আত্মীয় আখি সিরাজ (শ্বশুর), বদরে ইসলাম আবু জাহিদ (নাতি)

তারিকা: চিশতি

শিক্ষক:  আখি সিরাজ, নিজাম উল-হক শরফি

ছাত্র: আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনাণী, নুর কুতুব আলম।

হুজুরের তারিকা পরম্পরার তালিকাঃ

হুজর মইনুদ্দিন চিশতী আজমিরী(রাঃ) থেকে হুজুর কুতুবুদ্দিন বাখতিয়ার কাকি (রাহঃ) থেকে হুজুর ফরিদউদ্দিন গঞ্জে শাকার (রাহঃ) থেকে হুজুর নিজামুদ্দিন আউলিয়া !রাহঃ) থেকে হুজুর ওসমান সিরাজ উদ্দিন ওরফে আখি সিরাজ (রাহঃ) থেকে হুজুর মাখদুম আলাউল হক পান্ডবী (রাহঃ)।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter