আব্বাসী যুগের জ্ঞান চর্চা মুসলিম পন্ডিত ও দার্শনিকদের অবদান

ভূমিকা:

আব্বাসীয় যুগের জ্ঞান ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় অনেক আলোচনা রয়েছে। সেই যুগের জ্ঞানী কবি, লেখক এবং দার্শনিকরা এখনও আমাদের কাছে অমর। তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য বিশ্ব এখনও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এর কারণ কী ছিল, এর পিছনে আব্বাসীয় খলিফাদের কতটা হাত ছিল, আসুন এই প্রবন্ধে ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়, আব্বাসীয় যুগে জ্ঞান ও শিক্ষার অগ্রগতি এবং সেই যুগের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। আব্বাসীয় যুগে অনেক দার্শনিক, পণ্ডিত, ডাক্তার এবং বিজ্ঞানী প্রভাবশালী ছিলেন। জ্ঞান এবং বৌদ্ধিক গবেষণা আব্বাসীয় খলিফাদের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল, বিশেষ করে ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত। এই সময়কালকে ইসলামী জ্ঞান ও সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই যুগে অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবী সামনে এসেছিলেন। এবং এই তিনজন তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিশ্বকে অমূল্য উপহার দিয়েছিলেন।

খলিফাদের শিক্ষার প্রতি উৎসাহ 

খলিফারা বিভিন্নভাবে পণ্ডিতদের সাহায্য করেছেন এবং জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছেন। তারা সর্বদা জ্ঞান অর্জনের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। খলিফা হারুন আল-রশিদ ৭৮৬ থেকে ৮০৯ সাল পর্যন্ত বায়তুল আল-হিকমা (জ্ঞানের ঘর) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে, তার পুত্র মামুন ৮১৩ থেকে ৮৩৩ সাল পর্যন্ত এটি আরও সম্প্রসারিত করেন। এই বায়তুল আল-হিকমা মূলত জ্ঞান অর্জন এবং অনুবাদের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম গবেষণাগারগুলির মধ্যে একটি। এখানে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্ডিত, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদরা এই বায়তুল হিকমায় একত্রিত হতেন। এখানে, ফার্সি, ভারতীয়, গ্রীক, সিরিয়ান এবং অন্যান্য ভাষায় বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি এবং বই আরবিতে অনুবাদ করা হত এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করা হত। বাগদাদের মাটিতে বায়তুল আল-হিকমার প্রভাব এতটাই ছিল যে বাগদাদের গ্রন্থাগারগুলি বইয়ে ভরে গিয়েছিল।

আব্বাসী যুগের বিজ্ঞান চর্চা

বলা বাহুল্য যে আববাসি যুগে বিজ্ঞান চর্চা যে পরিমাণ এগিয়ে এসেছিল তা  সম্পর্কে ইতিহাস আজও সাক্ষ্য দেয়। সে কালে বিজ্ঞানীরা এমন এমন বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা যে বিষয় গুলি এখনও গবেষনা হচ্ছে। যেমন সে কালে আমাদের ক্যামেরার ধারণা দেন যা বহুকাল পরে আমাদের সামনে বাস্তব রুপে অবস্থান করে। তাছাড়া অ্যালজেব্রা"র নামক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলি আমাদের সামনে আসে এই ইতিহাসেে স্বর্ণযুগ আব্বাসী খিলাফত কালে ।

তাছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্টান মাদ্রাসা ও হাসপাতাল এই যুগে গড়ে ওঠে যেমন

দারুল ইলম যেটা ফাতেময় আমলে তবুও আব্বাসীদের প্রভাব ছিল। প্রতিষ্ঠানটির এখন বর্তমান অবস্থান  কাইরো। চিকিৎসা সাহিত্য চিত্র বিজ্ঞান বিষয় গবেষণা করা হতো এ প্রতিষ্ঠানে। খাজানাতুনকুতুব কিতাবের ভান্ডার মসজিদ মাদ্রাসা বিভিন্ন জনগণের জন্য একটি পাঠাগার এছাড়া বহু  মাদ্রাসা হাসপাতাল ইত্যাদ এই যুগে প্রতিষ্ঠিত করা হয় যেগুলির অবস্থান এখনো বিদ্যমান।

আব্বাসী জমানায় জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অমর অবদান রাখা কয়েকজন মহা মানব :

আল খোয়ারিজমি: 

ইতিহাসের মুসলিম স্বর্ণযুগের কারিগর বললে বলা বেশি হবে না। যখন বিশ্ব মুসলিম বিজ্ঞানের ও শিক্ষার  দিকে অগ্রসর হচ্ছিল  তখন এই আল খারিজমী তাদের এক পথ দেখান। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আলতাবারী তার নাম দেন মোঃ মোহাম্মদ  ইবনে মুসা আল খারিজমি কুতরুবুল্লি এই কুতরুবুল্লি  সম্ভবত নিশানা দেয় যে তিনি শহর  কুতরুবুল্লি থেকে এসেছেন। জন্ম অনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দ বহু কাল পূর্বে হওয়াই সঠিক জন্ম শাল পওয়া যায় না। ঐতিহসকদের মতে অনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দ। তিনার জ্যোতিবিদ্যা ভূগোল  মানচিত্র অংকন  ও গণিতে অগাদ কার্যক্রম রয়েছে। অসাধারণ মেধাবী এই বিজ্ঞানীর  স্প্যানিশ অনুবাদ আলগরিতমি থেকে ইংরেজি শব্দ আলগরিদম শব্দের প্রচলন। আবার তিনার নাম খরিজমি (খোরিজমি) অংশ থেকে স্প্যানিশ গুমারজমো শব্দটির ব্যবহার যার নাম ডিজিট বা সংখ্যা। তিনি ৮১৩ থেকে ৮৩৩ পর্যন্ত রচনা ও অনুসন্ধান  করেন। তিনি বাইতুল আল হিকমার প্রধান গ্রন্থাগার হিসেবে ছিলেন। বহু বই তিনি সাংস্কৃতি থেকে অনুবাদ করেন। ইনার এক বিশেষ কাজ এলজেব্রারার ধারণা, তাছাড়া “আল জাবার ওয়াল মোকা বলাতে” তিনি রফিক এবং দ্বিঘাত সমীকরণের প্রথম পদ্ধতিগত সমাধান দেন।হিব্রু বর্ষপঞ্জি নিয়ে “রিসালা ফি ইস্তেখরাজ তারিখ আলী আহুদ” শিরোনামে বইটি সম্পাদিত, কোন দিন মাসের প্রথম দিন হবে তা নিয়ে নির্ণয় করেন,এটি তৃষি নামেও পরিচিত।

 ১৯১৪ সালের রবার্ট অব চেষ্টার কর্তৃক অনুবাদ আল যেবার আল মোকাব্বিল বইটি ষড়য শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে পড়ানো হতো। তাছাড়া ঐতিহাসিকদের ধারণা এছাড়াও চেনার অধিক অবদান রয়েছে যা নিয়ে উপকৃত আজ পুরো বিশ্ব।

ইবনে সিনা 

পশ্চিমাতে তিনাকে আভি সিনা বলা হয় (Avicenna) পুরো নাম  আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা।  জন্ম বর্তমানে উজবেকিস্তান বোখারা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে  জন্মগ্রহণ করেন। এনাকে সাইকুল রাইইস নামে উপাধি দেওয়া হয় ইবনে সিনা ছোট থেকে ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি সর্বদা জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার দিকে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি কেবল তেরো বছর বয়সে  পুরো কোরআন হেফজ করে ফেলেন। ফিকহ শাস্ত্রের জ্ঞান লাভ তিনি  ইসমাইল জাহিদ থেকে করেন। গণিত  তাছাড়া দর্শন ও চিকিৎসা বিদ্যা অর্থনীতি জ্যামিতি বিজ্ঞান সাহিত্য কাব্য জ্ঞান লাভ করেন। যদিও সাহিত্যে ইনার  অবদান খুব কম। অ্যারিস্টোটলের লেখা দা মেটাফিজিকস বইটি ৪০ বার পড়েন তবুও কিছু বুঝতে পারেন না। পরে তিনি আল ফাবারির লেখা এ মেটা ফিজিক্সের অনুবাদ পরে তিনি পুরোটাই বুঝে ফালেন। 

এছাড়াও পরে তিনি  চিকিৎসার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি  রোগীদের দেখতেন ও মানুষ কিভাবে একটি রোগে আক্রান্ত হয় সে বিষয়ে ভাবতেন। বোখারার বাদশা একদা ভিশন রোগে আক্রান্তিত হলে সকল চিকিৎসক হার মেনে নেয় সে সময়ে ইবনে সিনা তার চিকিৎসা দ্বারা বাদশা কে  সুস্থ করে তোলেন, এরপরে তিনি বাদশার শাহী চিকিৎসক হয়ে যান। এবং তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করতে থাকেন। তিনি যেসব বিষয়ে গবেষণা করেন সে রোগ গুলি হল ক্যান্সার, টিভি ও ছোঁয়াচে রোগ। এভাবে তেনার কঠিন পরিশ্রম  ও তিনার চিকিৎসা বিদ্যার দ্বারা আজও সকলের কাছে তিনি জীবিত। তিনি চিকিৎসা জগতে অনেক পরিবর্তন আনেন যেগুলি আজও ব্যবহৃত হয়। যেমন তিনি অপারেশনের আগে অজ্ঞান করা বিষয়টি সকলের সামনে তুলে আনে যখন কেউ জানতো না অজ্ঞান বিষয়ে তিনি প্রথম অজ্ঞান বিষয়টি আবিষ্কার করেন। তিনার লিখা একটি বিখ্যাত বই “আল কানুন ফি তীব” এই বইয়ে তিনি প্রথম খন্ডে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ,  দ্বিতীয় খন্ডে ভিন্ন সরঞ্জাম ও ওষুধ সম্পর্কে আলোচনা করেনও, তৃতীয় ও চতুর্থ তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিষয়ে লিখেন, পঞ্চম খন্ডে ওষুধ তৈরি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন।এ বইটি পরবর্তীতে ল্যাটিনে ভাষান্তর করা হলে ইউরোপের প্রধান চিকিৎসা বই হিসেবে পড়ানো হয়। তিনার চিকিৎসার উপর অবদান চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে খেলাফত পরিবর্তন হলে এনাকে সেই বোখারা ছেড়ে চলে যেতে হয় এরকমভাবে তিনি নিজের জীবন লোকেদের স্বার্থে সমর্পণ  করেন। ইবনে সিনা তার ৫৭ বছর বয়স 1037 খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।তিনার সমাধিস্থল হামদান শহরের স্থাপিত করা হয়। 

উপসংহার

 আব্বাসী যুগে জ্ঞানের প্রচার প্রসার অনেক হয়। মনে করা হয় আব্বাসী যুগের সেই কালে লাইব্রেরীগুলো বইয়ের জায়গা দিতে পারছিল না। পরবর্তীতে হালকু খান চেঙ্গিস খানের পুত্র বাগদাদ দখল করে মুসলিম জাহানের সমস্ত সম্পদকে তারা বিলিয়ে দেয়। নীল দরিয়াতে সমস্ত বইগুলোকে নির্মমভাবে ফেলে দেয়া হয়। বলা হয় নীল পানি বইয়ের কালীর জোরে কালো হয়ে গিয়েছিল। অফুরন্ত জ্ঞান ভান্ডার ও বই বিশ্বজাহান সেই দিন হারিয়ে ফেলে। তিনার লিখা মোট  বই সংখ্যা 450টি যার মধ্যে কেবল 250 টি পওয়া যায়।

এই যুগে অনেক জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিরা উঠে আসেন জ্ঞান প্রসারের জন্য আমি চেষ্টা করলাম কয়েকজনের জীবনী সংলাপ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্বে আরো কয়েকজন ব্যক্তিবর্গদের সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করব। এই প্রবন্ধ অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আমি এখান থেকে সীমিত রাখলাম। পরবর্তীতে আপনারা চাইলে আবার এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।












Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter