জামা

দেখতে দেখতেই ঈদের দিন এক্কেবারেই খুব নিকটে চলে আসলো। এখন থেকেই যেন সমস্ত পাগল পারা মুসলিমদের খুশির অন্ত নেই। কারণ আর মাত্র পাঁচটা দিনের পরেই তো হৃদয়ের লালায়িত সেই কাঙ্ক্ষিত আনন্দের জোয়ারে ভরিয়ে দিতে ঈদুল আযহা দিনটি আসতে চলেছে।           ফরিদ দূর্দান্ত একটা অনিন্দ্য সুন্দর বালক, কি অপরূপ তার চেহেরা। মাশাল্লাহ, তার প্রাণোচ্ছল হাঁসি এবং মায়াবী সুরতের দিকে যার নজর পড়ে কেউ নিজের নজর ফিরাতে পারেনা। যত দেখে ততোই ভালো লাগে। সেই সাথে তার কচি মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলো সত্যিই যে কারোরই মন মুগ্ধ করে দেই। ফরিদরা দুই ভাই বোন। ফরিদের বাবা হিশাম একজন হতদরিদ্র দিন মজুর মানুষ। সে দিন আনে দিন খায় । খুব কষ্টে তাদের দিন কাটে। যেই দিন মজদুরি পায় সেইদিন তো কোনো অসুবিধা হয় না, কিন্তু যখন লাগাতার কয়েক দিন কাজ পায় না তখন সংসার চালানো তার জন্য প্রচণ্ড দুর্বিষহ হয়ে যায়।                                  

আজ অনেক দিন হয়ে গেল হিশামের কোন কাজ কাম নেই, শুধু হিশামের নই অনেক মানুষই করোনার বিষাক্ত থাবাই গৃহবন্দি হয়ে আছে। কোনো কর্ম করতে পারছেনা, পারছেনা নিজেদের সাংসারিক সামান্য চাওয়া গুলোও পূর্ণ করতে। দুর্বিষহ হয়ে গেছে সাধারণ নিম্নবৃত্ত পরিবারগুলোর জীবন ধারণ। যাই হোক, ঈদটা কাছিয়ে এসেছে কিন্তু হিশামের হাতে তো একটা ফুটো কানাকড়িও নেই। কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না সে।                                        

আজ সকাল বেলায় ছোট্ট ফরিদ তার পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে ব্যাস্ত আছে।  সব বাচ্চারা বেজায় খুশি। সবাই মিলে তাদের হাতের কচি কচি আঙ্গুল দিয়ে ঈদ আসতে আর কদিন বাকি আছে গুনছে আর হাসছে আনন্দ ফুর্তি করছে। হঠাৎ করে ফরিদের বন্ধু নাফিস বলছে - ফরিদ এই ফরিদ জানিস গত কালকে না আমার আব্বু আমার জন্য বাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের খুব সুন্দর জামা প্যান্ট এনেছে। সেই গুলো দেখে আমার যে কি আনন্দ তোকে বোঝাতে পারবোনা। আম্মু বলছিল আমি এইগুলা পড়লে না কি আমাকে হিরোর মতো লাগবে। ঈদের দিন ওই গুলো পড়েই আব্বুর সাথে ঈদগাহে যাবো তখনই দেখতে পাবি কত সুন্দর আমার জামা।

নাফিস বড়োলোক ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান। কোথায় নাফিস আর কোথায় দিনমজুর হতদরিদ্র বাবার সন্তান ফরিদ। দুই জনের ব্যবধান যে আকাশ-পাতাল।  একজন চাওয়া মাত্রই সবকিছু পেতে পারে কিন্তু আরেকজনের হাজার চাওয়া দারিদ্রের কষাঘাতে মরে যেতে বাধ্য হয়। নিয়তির খেলা মনে হয় এটাকেই বলে। কেউ শত আবদারের পরও খেতে চায় না আর কেউ পেটের ক্ষুধা মেটাতে দুই মুঠো ভাত পায় না। কেউ কোন টা কাপড়ের সেট পড়বে সেইটা নির্ধারণ করতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে। আবার কেউ লজ্জা ঢাকতে একফালি কাপড় পায় না। সব কিছুই বিধাতার ইচ্ছা আর কি!    

যাই হোক এইবার নাফিস ফরিদকে জিজ্ঞেস করে: আচ্ছা ফরিদ তোর আব্বু তোর জন্য কি কিনলো কিছুই তো বললিনা?   ফরিদ কাঁচু মাচু করে বলে: দোস্ত, আসলে এখনো পর্যন্ত আব্বু আমার জন্য কোন কিছুই নিয়ে আসেনি। শুধু আমার জন্যই না বোনের জন্যেও কিছুই কিনেনি। আমার মনে হয় আজ কালকের মধ্যেই আমার আব্বু আমার আর আমার বোনের জন্যে ঈদের সুন্দর নতুন জামা কিনবে। তখন দেখিস কতো সুন্দর লাগবে!                                              

এই বলে ফরিদ নাফিস কে বলে: দোস্ত এখন তবে আমি বাড়ি যাই। আব্বুকে জিজ্ঞেস করি, আমাদের জন্য কখন বাজার করবে? যাই দোস্ত ভালো থাকিস পরে আবার দেখা হবে। ফরিদ তার বন্ধু নাফিসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে নিজের বাড়িতে। এসেই তার আব্বু হিশামকে জিজ্ঞেস করে:  আব্বু, ও আব্বু! আমাদের জন্যে ঈদের জামা কখন আনবে?  নাফিসের আব্বু তো নাফিসের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে জামা কিনেছে, তুমি আমার ও বোনের জন্যে কখন জামা নিয়ে আসবে আব্বু? আব্বু বলনা। চুপ করে আছো কেন? বল, কখন আনবে ?                                

ছোট্ট ফরিদের এই আবদার শুনে পিতা হাশিম আর কিছুতেই নিজের কান্না চেপে রাখতে পারে না। অশ্রু গুলো মুহূর্তেই চোখের সাথে বেইমানি করতে শুরু করেছে। দুক্ষে কষ্টে তার বুকটা জানি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কি বলবে তার এই অবুঝ শিশুটাকে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।  তাদের কে কোনো কিছু কিনে দেবার নূন্যতম সাধও যে তার নেই। কিন্তু মুখের ওপর তো বলতে ও পারে না,  যে এইবার তোমাদের কে কিছু নিয়ে দিতে পারবো না বাবা।  কারণ নয়নের মনি আদরের সন্তান চোখের সামনে ধুলোই গড়া গড়ি দিলে কোনো পিতা মাতাই তাহা সহ্য করতে পারে না। হোক সে কোটিপতি কিংবা ভিখারি। সন্তান তো সন্তানই হয়। নিজের সন্তান যেমনি হোক সেটা নিজেরই।                          হাশিম ছোট্ট ফরিদের মাথায় আদরের হাত বুলাতে বুলাতে বলে: কেন দিবো না? তোমাদেরকেও দারুন সুন্দর পোশাক কিনে দেবো। ঈদ আসতে তো আরও কোয়েক দিন বাকি আছে, না বাবা? চিন্তা করিও না, ঈদের আগে আগেই তোমাদের আসা পূর্ণ হবে সোনা। এইভাবে হাশিম তার পুত্র ফরিদকে বোঝাই।                                                         

কিন্তু সে তো ভালো ভাবেই জানে যে তার আসলে কোনো সামর্থই নেই ঈদের বাজার করার। এইদিকে দিন যেতে যেতে এক্কেবারেই সন্নিকটে চলে এসেছে। কালকেই ঈদ কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাবা তো আমাদের জন্যে কিছুই আনছে না। বাবা কি তাহলে আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে?  এই ভেবে মন খারাপ করে ফরিদ তার আব্বু হিশামের কাছে যাই। আর সেখানে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই সে দেখতে পায় তার আব্বু শুয়ে শুয়ে কান্না করছে। ফরিদ তার আব্বুকে ডাকে: আব্বু ও আব্বু কেনো কাঁদছ তুমি? কি ব্যাপার আব্বু, তোমার কি কিছু হয়েছে? হিশাম এইবার পুত্রের কথা শুনে নাবালক শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে এবং বলে বাবা ফরিদ আমার কিছু হয়েছে বলে আমি কাঁদছি এইরকম কিছু নয়রে বাপ।            

আমি কেন কাঁদছি শুনবি রে আব্বু? আমি কান্না করছি এই জন্যে যে আমি তোদের এমন একজন হতভাগ্য বাবা যে নিজের সন্তানের সামান্য একটু চাওয়া পূর্ণ করতে পারছি না। তোকে কি বলবো বাপ দুঃখে যে বুক টা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক্ষনি যদি মোরে যেতে পারতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো!                                   

আব্বুর এই বুকফাটা আর্তনাদে ছোট্ট ফরিদও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে” আব্বু তুমি আর কেঁদো না আব্বু । তুমি কাঁদলে যে আমাকে কিছুই ভালো লাগে না। আমাদের কোন নতুন জামা কাপড় লাগবে না আব্বু। আমি তো তোমাকে এমনই এমনই জামার কথা বলেছিলাম।  গত বছরের আমার যেটা জামা আছে আমি সেইটা পড়েই তোমার সাথে ঈদগাহে যাবো।  কি আনন্দ হবে বলো আব্বু। এই বলে পিতা পুত্রে গলা গলি করে তারা কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লো। আর ঘুম থেকে উঠে দেখে ঈদের আনন্দে আজকে সুর্যটাও যেন সারা বিশ্বময় খুশির কিরণ ছড়িয়ে দিয়েছে।                                                                                       

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter