আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়: সময়ের সেতুবন্ধনে স্থাপত্য এক আলোর মিনার
আজও যদি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কোনো মুসলিম বা অন্য সমাজের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়, অধিকাংশ মানুষই ইতালি বোলোগনা শহরে অবস্থিত, ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেন। অথচ ইউনেস্কো এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর স্বীকৃতি অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম এবং প্রাচীনতম কার্যকর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মরক্কোর ফেজ শহরে অবস্থিত আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় কে গণ্য করা হয়, যা ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে একজন মুসলিম নারী—ফাতিমা আল-ফিহরি—এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেক মুসলিম সমাজ এই গর্বিত ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত নন। এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও অনেকের অজানা থেকে গেছে, যদিও এটি আজও সক্রিয়ভাবে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে এবং ইসলামী জ্ঞানচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
তাই এই প্রবন্ধে আমরা সেই ঐতিহাসিক ও গৌরবময় প্রতিষ্ঠান আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করব, যা শুধুমাত্র মুসলিম সভ্যতার নয়, বরং মানব সভ্যতার উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়
আল-কারাওইন ইউনিভার্সিটি মরক্কোর প্রাচীন নগর ফেজে অবস্থিত একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা ইতিহাসে তার ব্যতিক্রমী অবস্থানের জন্য প্রসিদ্ধ। ইউনেস্কো (জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা) এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর মতে, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং অবিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
এছাড়াও, জর্জ মাকদিসি, সায়্যিদ ফারিদুল আত্তাস, মোহাম্মাদ আকরাম নাদভি প্রমুখ খ্যাতনামা পণ্ডিত একে বিশ্বের প্রথম প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করেছেন।
এই জ্ঞানদীপ্ত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ফাতিমা আল-ফিহরি, এক বিশিষ্ট মুসলিম নারী, যিনি ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই মাদ্রাসা পরিণত হয় এক আধ্যাত্মিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কেন্দ্রে, যা গোটা মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রে রূপ নেয়। পরবর্তীকালে, ১৯৬৩ সালে, আল-কারাওইনকে মরক্কোর আধুনিক রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাঠদান ও একাডেমিক কাঠামো
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম গঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষার মূল ভিত্তির উপর। এখানে ধ্রুপদী আরবি ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব, মালিকি মাজহাবভিত্তিক ফিকহী মাসাইল, এবং ধর্মীয় ও আইনি জ্ঞানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষাদান প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ — শিক্ষার্থীরা একটি অর্ধবৃত্তে (হালাকা) বসে একজন শায়খের সান্নিধ্যে পাঠ গ্রহণ করে, যেখানে শিক্ষক নির্ধারিত পাঠ্য পাঠ করান, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিষয় বিশ্লেষণ করেন এবং মৌলিক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করেন।
এই পদ্ধতির শিকড় গবিরভাবে পৌথিত ইসলামের সূচনালগ্নে, যেমন নবী মোহাম্মাদ সাঃ এর যুগে মসজিদে নববীতে সাহাবাগন হালকার মাধ্যমে তার থেকে সরাসরি জ্ঞান অর্জন করতেন।
ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি, আধুনিক যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এখানে ফরাসি, ইংরেজি ও অন্যান্য আধুনিক বিষয়েরও পাঠদান করা হয়। ফলে, প্রতিষ্ঠানটি একদিকে ইসলামী ঐতিহ্য আর অন্যদিকে আধুনিকতা — এই দুইয়ের সেতুবন্ধন হিসেবে বিবেচিত।
আন্তর্জাতিক আবেদন ও ভর্তি প্রক্রিয়া
আল-কারাওইনের খ্যাতি বহু আগেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হয়েছে। মরক্কো ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, এমনকি স্পেনের মুসলিম সম্প্রদায় থেকেও শিক্ষার্থীরা এখানে অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন। বিশেষ করে আন্দালুসীয় ইসলামি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহনকারী মরোক্কান শায়খদের প্রতি আকর্ষণ থেকেই অনেক শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হন।
প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী; যারা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করে ডিপ্লোমা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের স্নাতক ডিগ্রির দিকে অগ্রসর হয়। এখানে ভর্তি হতে হলে শুধু মুসলিম হওয়াই যথেষ্ট নয়; শিক্ষার্থীদের ধ্রুপদী আরবি ভাষায় দক্ষতা, কুরআন অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা, এবং ব্যাকরণ ও মালিকি ফিকহের প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হয়।
অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল পুরুষদের জন্য। বাস্তবে, ১৯৪০-এর দশক থেকেই নারীরাও এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে আসছেন। আজ, এটি লিঙ্গ-সমতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিবেচিত।
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়: একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপরি একটি মসজিদের রুপে নামাজ আদায় করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এহ মসজিদেই শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা খুব সম্ভবত তার প্রারম্ভিক যুগেই ঘটে, কারণ ইসলামি সভ্যতার প্রাথমিক যুগে প্রধান মসজিদসমূহ শুধু নামাজের স্থানই ছিল না; সেগুলো ছিল ধর্মীয় শিক্ষা, বিচার ও নাগরিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ৯১৯ বা ৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আল-কারাওইন মসজিদে জুম্মার খুতবা প্রচার শুরু হলে এটি ফেজ শহরের প্রধান মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ক্রমে ধর্মীয় ও শিক্ষাবিষয়ক মর্যাদা লাভ করে।
১১শ শতাব্দীর দিকে এই মসজিদ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। ইতিহাসবিদ ডঃ আব্দুল হাদি তাজী তিনার তিন খন্দের রিসার্চ ওয়র্ক আল-কারাওইন ইউনিভার্সিটি হিস্ট্রি গ্রন্থে ১১২১ খ্রিষ্টাব্দে এখানে সংগঠিত পাঠদানের সুস্পষ্ট প্রমাণ উল্লেখ করেন। অন্যদিকে, মরক্কোর ঐতিহাসিক মুহাম্মদ আল-মানুনি বিশ্বাস করেন, আলমোরাভিদ বংশের আমলেই (১০৪০–১১৪৭) মসজিদটি একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে রূপান্তরিত হয়। এরপর মারিনিদ বংশের আমলে (১২৪৪–১৪৬৫) এটি এক বিশাল শিক্ষা ও জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সময়ে আল-কারাওইন-এর পাঠ্যক্রম বিস্তৃত হয়, যাতে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, ব্যাকরণ, যুক্তি, অলংকারবিদ্যা, চিকিৎসা, গণিত, ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যদিও রসায়নের মতো কিছু বিষয়কে অপ্রচলিত বলে বাদ রাখা হয়।
১৩শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আল-কারাওইনের পারিপার্শ্বিক এলাকায় একাধিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে—যেমন সাফফারিন (১২৭১), আত্তারিন (১৩২৩), এবং মেসবাহিয়া (১৩৪৬)। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত আল-কারাওইনের সহায়ক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করত, বিশেষ করে বাইরের অঞ্চল থেকে আগত দরিদ্র ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করে তাদের শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করত।
১৩৪৯ সালে মারিনিদ বংশের সুলতান আবু ইনান ফারিস আল-কারাওইন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারটিতে মাঘরেব, আন্দালুস ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সংগ্রহিত অসংখ্য দুর্লভ ও মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে ইমাম মালিক বিন আনাসের “আল-মুয়াত্তা”, ইবন ইসহাকের “সীরাত আল-নাবী”, ৯ম শতাব্দীর একটি কুরআনের পাণ্ডুলিপি, এবং ইতিহাসবিদ ইবন খালদুনের নিজ হাতে লেখা “আল-মুকাদ্দিমাহ”। এছাড়াও এখানে ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের একটি চিকিৎসা-সনদও (ইজাযা), সংরক্ষিত রয়েছে যা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন "মেডিকেল ডিগ্রি"- বলে পরিচিত।
প্রাচীনকালে আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য পাঠদানের সুযোগ ছিল। তবে মহিলারা বিশেষ গ্যালারি থেকে বক্তৃতা শ্রবণ করতে পারতেন। এই জ্ঞানচর্চার মহতী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বিখ্যাত মনীষী—যেমন ইবন আরাবি, ইবন খালদুন, আল-ইদরিসি, ইবন আল-খতিব ও আল-বিত্রুজি। এমনকি খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন, যেমন নিকোলাস ক্লেইনার্টস ও জ্যাকবস গলিয়াস।
পরবর্তীকালে, বিশেষত ১৮শ শতকের শেষ দিকে থেকে প্রতিষ্ঠানের মান ও পাঠক্রম সংকীর্ণ হতে শুরু করে। ১৭৮৮-৮৯ সালে আলাভী বংশের সুলতান মুহাম্মদ ইবনে আবদাল্লাহ কিছু সংস্কার করেন এবং যুক্তি, দর্শন ও সুফিবাদের কিছু অংশ পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেন। ১৮৪৫ সালে সুলতান আবদুর রহমান বিন হিশাম কিছু অতিরিক্ত সংস্কার করলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল স্পষ্ট নয়।
ফরাসি ঔপনিবেশিক যুগে (১৯১২–১৯৫৬) আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবনতি ঘটে। যদিও কিছু কাঠামোগত সংস্কার হয়—যেমন শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যসূচি নির্ধারণ, ইজাযাহ বাতিল করে "শাহাদা আলামিয়া" চালু—তবে পাঠ্যবিষয়ে আধুনিকীকরণ হয় না।
অবশেষে ১৯৪০-এর দশকে প্রথমবারের মতো নারীদের শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে এটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় এবং এক নতুন ক্যাম্পাসে ক্লাস স্থানান্তরিত হয়। এরপর মরক্কোতে চারটি অনুষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ফেজ, মারাকেশ, তেতোয়ান ও আগাদিরে।
১৯৮৮ সালে রাজা হাসান দ্বিতীয় পুনরায় ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা চালু করেন, যা একদিকে মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর অন্যদিকে রক্ষণশীল রাজনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করণের কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমান যুগে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনা সংমিশ্রণের জীবন্ত নিদর্শন।
উপসংহার
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি ইসলামী জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি ও নারী নেতৃত্বের এক গৌরবময় নিদর্শন। যুগে যুগে এটি ধর্মীয় ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম মনীষীরা একত্রে জ্ঞান লাভ করেছেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠান তার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে এবং আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আল-কারাওইন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শিক্ষার শক্তি জাতি ও সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং, আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মরক্কো বা মুসলিম সমাজের গর্ব নয়; এটি মানবসভ্যতার জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এই ঐতিহ্যকে জানাও জরুরি, আর সংরক্ষণ করা তো তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন, যেন আগামী প্রজন্ম একে শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, জীবন্ত চেতনায় ধারণ করতে পারে।