চলচ্চিত্র শিল্পে ইসলামোফোবিয়ার প্রচারণা
ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে মুসলমানদের নেতিবাচক প্রস্থাপনা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলতঃ সাম্প্রদায়িকতার সাথে সাথে দেশের বহুত্ববাদী পরিচয়ের উপর এক কালো দাগ পড়তে দেখা যায়।
ঐতিহাসিক ঐতিহ্য
ভারতীয় চলচ্চিত্র যা বেশিরভাগই বোলিউড হিসাবে চিহ্নিত গ্রামীণ থেকে শহর, ইতিহাস থেকে বর্তমান, রাজনীতি, অপরাধ, সংস্কৃতি, ধর্মের মত বিভিন্ন উদীয়মান সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃশ্যগুলি তুলে ধরে আসছে।
দেশ নির্মাণ প্রকল্পে স্বাধীনতা এবং এবং দেশ ভাগের পর ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে ধার্মিক ঐকতা এবং সামাজিক সম্প্রীতি বিশেষ এক স্থান পায়। একই সময়ে, প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক এবং জাতিগত কুসংস্কার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধশক্তি হয়ে প্রকাশ হয় অনেক ছবি। এই ঐতিহ্য এখনও জয় ভিম (২০২১), আর্টিকেল ১৫ (২০১৯)-এর মতো কিছু ছবিতে অবশিষ্ট থাকে। বহুসাংস্কৃতিক সমাজে ধর্মীয় সাদৃশ্যের ঐতিহ্যও সিনেমাটিক উপস্থাপনায় একটি বিশাল মনোযোগ পেয়েছে।
“ঐতিহ্যগতভাবে, ধর্ম হিন্দি সিনেমাতে একটি বিষয়ই ছিলনা।” (শাহ, ২০১৬) তাছাড়া, ধর্মীয় উপস্থাপনা একটি সুসংগত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বোপরি, যেটুকু ধর্মীয় উপস্থাপনা ছিল তা একটি মনোহর উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত থাকতো যেমন ডঃ শেফালি বালসারি-শাহ বলেন যে সাম্প্রদায়িক বৈচিত্রসমুহ যেমন ধর্ম, ভাষা, আচার-আচরণ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলির ছবিতে দেখা যায়, তবে বৈষম্য বা অসহিষ্ণুতার উপকরণ হয়ে নয়।
বর্তমান বিবর্তন
অর্থাৎ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সৌন্দর্যকে প্রচার করার জন্য এসব দেখানো হতো। এই শ্রেণীতে, কিছু নমুনা ছবি যেমন হম দোনো (১৯৬১), পরিণয় (১৯৭৪), অঙ্কুশ (১৯৮৬) ইত্যাদি। অনুরূপ, জাতীয় গর্বের উদাহরণ হিসাবে, আনারকলি, মুমতাজ মহল ও মুগল-ই-আজমের মতো চলচ্চিত্রে ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে 'ভারতীয় মুসলমানদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য' তুলে ধরেছে। তাছাড়া, এই ছবিগুলি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দাবি করা সেরা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
তবে, রাজনৈতিক বিবর্তনের সাথে, এই ঐতিহ্যটি ধারাবাহিকভাবে হারাতে থাকে। সম্পাদক নন্দিনী রামনাথ বলেছেন ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের সাথে সাথে ‘মুসলমানদের অবস্থান’ দেশে দ্রুত পরিবর্তন হতে দেখা যায়। কিছু প্রধান ক্ষেত্র যেখানে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হয় সেগুলি কখনও ইতিহাস নিয়ে তো কখনও ধর্ম ও সমাজ নিয়ে।
টিইযেইআর (TIJER) ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক লেখায় ৩০টি চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ করে সারাংশে বলা হয় যে, "২২টি ছবির মধ্যে ভারতীয় মুসলমানদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে মাত্র ৪টি ইতিবাচকভাবে চিত্রিত, এবং ৪টি ছবি মিশ্রিত রঙে ৪%।” এই চলচ্চিত্রগুলিতে সন্ত্রাসী বা মাফিয়া বসের মতো চরিত্রে সর্বদা মুসলমানদের রাখা হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে এই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের প্রবণতাটি গতিবেগ অর্জন করেছে। কাশ্মিরি ফাইল (২০২২), দ্য কেরালা স্টোরি (২০২৩), ৭২ হুরেন (২০১৯), আজমের ৯২ (২০২৩), ইত্যাদি আইএমবিডি-এর ওয়েবসাইটে ‘প্রচারণামূলক ভারতীয় চলচ্চিত্র' হিসাবে তালিকাভুক্ত কয়েকটি উদাহরণ। সাইটটি সতর্ক করে যে ‘এই সিনেমাগুলি ভারতে মুসলমান, শিখ, দলিত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করতে পারে। এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের নিয়ে বিকৃত ইতিহাস দেখাতে পারে।’
একটি বিশ্লেষণ
বিশ্লেষণে দ্য কেরালা স্টোরি-র উপর একটু বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যাক। ছবিটিতে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষপাতদুষ্ট উপস্থাপনের উপাদান রয়েছে যেমন কটূক্তিমূলক চরিত্রায়ন, বর্ণনার ভুল ব্যাখ্যা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি যা দেশের সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে উস্কে ইসলামফোবিয়ার উদ্বেগজনক উত্থানে অবদান রাখে। দুর্ভাগ্যবশত, ছবিটি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল।
সুদীপ্ত সেন পরিচালিত, দ্য কেরালা স্টোরি, সমালোচকদের কাছ খুব একটি খারাপ রেটিং পেয়েছে। ছবিটি ইসলাম, মুসলমান এবং কেরালা রাজ্যকে নির্বিচারে লক্ষ্যবস্তু তৈরি করেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাইন বিজয়নের মন্তব্য অনুসারে, ছবিটি ‘সংঘ পরিবার প্রচার’ এবং ‘লাভ জিহাদ’-এর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি। আদাহ শর্মা অভিনীত ছবিটি দেখায় কিভাবে অমুসলিমরা মেয়েরা লাভ জিহাদের চক্রান্তে প্ররোচিত হয়ে ইসলামিক স্টেটের বৈশ্বিক মিশনে যোগদান করে।
উদাহরণস্বরূপ, টিজার ট্রেলার অতিরঞ্জিত দাবি করে যে ৩২,০০০ কেরালার মহিলা আইএসআইএস-এ যুক্ত৷ যাইহোক, উপলভ্য ডেটার সঠিক ব্যাকিং ছাড়াই ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার পর সংখ্যাটি হ্রাস করা হয়। এই মিথ্যা নিয়ে টিজারটি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে যা ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সহনশীলতার ভিত্তিতে রাজ্যের সত্য গল্পগুলি নষ্ট করে।
মূল কারণ ও বিবেচনা
দেশে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক ফাটল সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ ও উসকানিই কেন্দ্রীয় শক্তি। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক নানিয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির এক প্রকাশনায় (দ্য রোল অফ দ্য মিডিয়া ডুরিং কম্যুনাল রাইটস ইন ইন্ডিয়া: এ স্টাডি অফ দ্য ১৯৮৪ শিখ রাইট্স এবং ২০০২ গুজরাট রাইট্স) দেখা গেছে, “ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা স্বতঃস্ফূর্ত নয় এবং খুব কমই কোনো ধর্মীয় শত্রুতার কারণে হয়। তারা সাধারণত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে উদ্ভূত হয়, যা প্রায়শই অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে যুক্ত থাকে।”
মিডিয়া যেকোনো ধরনের সামাজিক কৌশলে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এর উপস্থাপনা সরাসরি গণ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে যেখানে। খুব কম মানুষের মিডিয়ার সত্য-মিথ্যা উপস্থাপনার মধ্যে বাছাই করতে পারে। একইভাবে, এটি বহুত্ববাদ এবং সামাজিক গল্পের প্রচার ক্ষেত্রেও একটি কেন্দ্রীয় অনুঘটক হয়ে ওঠে। এবার এটি বিবেচনা করা উচিত, ভারতীয় মিডিয়া তার স্বতন্ত্রতা হারিয়ে কোন দিশায় অগ্রগতি হচ্ছে।